দাপুটে ওসি থেকে কনডেম সেলে প্রদীপ

জিয়াবুল হক, টেকনাফ »

চোরাচালানের রাজ্য খ্যাত টেকনাফের মানুষদের ভয় আর আতঙ্কের পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন সেখানকার থানার এক সময়ের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ।

জানা যায়, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানকার জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সেই কমিটি বলেছে, পুলিশের ভাড়া খাটা মাইক্রোবাসের চালক দিদার মিয়া কমিটিকে বলেছেন, টেকনাফে পুলিশের কথা শুনলে মানুষ ভয়ে প্রশ্রাব করে দিত। ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় ৩৩ মাস দায়িত্ব পালন করেন। সেইসময় ১০৬টি ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। এতে নিহত হন ১৭৪ ব্যক্তি। এলাকাবাসীর অনেকে বলেন, এ তথ্যই বলে দেয় কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন ওসি প্রদীপ। তবে তিনি তার বাহিনী থেকে বহু প্রশংসা পেয়েছেন। পদকও  পেয়েছেন। অবশ্য একাধিকবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে বরাবরই ‘ভালো জায়গায়’ পদায়নও হয়েছে তার। তিনি যে এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন, তাকে নিয়ে সেবাপ্রত্যাশীরা মন্তব্য করতেন, ‘এ যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার।’

সিনহা হত্যা মামলার রায়ে ফাঁসির দ- হয়েছে প্রদীপের। নিজের অপকর্মের কারণে ওসি থেকে ফাঁসির আসামি হলেন আলোচিত-সমালোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা। কোনো ফৌজদারি মামলায় ওসি ফাঁসির আসামি হয়েছেন- এ ধরনের নজির এই প্রথম।

২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ  মেডাল বা বিপিএম পেয়েছিলেন ওসি প্রদীপ। পদকপ্রা প্তির সাইটেশনে তার ছয়টি ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনার উল্লেখ ছিল। তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার বলেছেন, তিনি দায়িত্বে থাকাকালে যেসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বেশির ভাগ জায়গায় তিনি নিজের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন।

২৫ বছরের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রদীপ ঘুরেফিরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন।

তার গ্রা মের বাড়ি বোয়ালখালীতে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) থাকাকালে জায়গা দখল, আইনজীবীকে মারধরসহ নানা বিতর্কিত কাজে জড়ান তিনি। ২০০৪ সালে সিএমপির কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা দখলের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। ওই ঘটনায় সিএমপি থেকে তাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। কিছুদিন পর চট্টগ্রাম রেঞ্জ  থেকে তাকে কক্সবাজার জেলায় বদলি করা হয়।

এ ছাড়া ২০১৫ সালে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় থাকাকালে একটি রিফাইনারির তেল আটক করে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন প্রদীপ।

তাকে দীর্ঘদিন ধরে  চেনেন, এমন একাধিক কর্মকর্তা জানান, একসময় পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আস্থাভাজন ছিলেন প্রদীপ। তাকে ‘ম্যানেজ’ করেই ‘ভালো ভালো জায়গায়’ পোস্টিং পেতেন। ওই কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর কিছুদিন বিপাকে ছিলেন। পরে নতুন কৌশল নেন তিনি। অতীতে যে কর্মকর্তার আস্থায় ছিলেন, নানা জায়গায় তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য শুরু করেন। এভাবে নতুন গুরুকে বশে আনার কৌশল নেন। টেকনাফ উপজেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণের আড়ালে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেক কাজ করেছেন, এলাকার সবাই সেটা জানলেও প্রদীপের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না।

টেকনাফের বাসিন্দারা জানান, প্রদীপের কক্ষে ঢোকার জন্য আলাদা দুটি দরজা ছিল। যাদের আটকের পর বাণিজ্য করার লক্ষ্য থাকত, তাদের ছোট দরজা দিয়ে  ঢোকানো হতো, যাতে সিসিটিভির ফুটেজে কোনো আলামত না থাকে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, চাকরি জীবনে বিভাগীয় মামলার কারণে পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয় প্রদীপের। তবে নিজের প্রভাব বলয় কাজে লাগিয়ে এসব থেকে ভালোভাবে উতরে যান তিনি।

২০০৯ সালের শেষে এসআই থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১০ সালে তার পদায়ন হয় সিএমপিতে। ২০১১ সালে পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানার ওসি হন। ২০১৫ সালে সিলেট রেঞ্জে বদলি হয়েছিলেন। অল্পদিন সেখানে থাকার পর আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। এরপর কক্সবাজারের মহেশখালীর ওসি হিসেবে নিযুক্ত হন। মহেশখালীতে জলদস্যু দমনে ভূমিকা রেখে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসেন। ২০১৮ সালের মে মাসে টেকনাফ থানায় বদলি হন।

টেকনাফের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টেকনাফে যাওয়ার পর প্রথমে কিছু দিন বিতর্কমুক্ত ছিলেন। এরপর শুরু করেন নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। একজনকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে ১৫-২০ জনকে আসামি করতেন তিনি। অনেককে মামলার জালে আটকে অর্থ বাণিজ্য করতেন। তার মামলার ভয়ে  কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন। নিরীহ অনেককে ধরে নিয়ে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতেন তিনি। অধিকাংশ  ক্ষেত্রে ভিকটিম পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হতো। টাকা দেওয়া না হলে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ভয় দেখানো হতো। এ ছাড়া টেকনাফ এলাকা দাপিয়ে বেড়াত প্রদীপের সিভিল টিম। তার টাকা উপার্জনের আরেকটি পথ ছিল গরু পাচার ও কাঠের ব্যবসা। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে প্রদীপের গভীর সখ্যতা ছিল। তাদের মাধ্যমে হাজার হাজার গরু মিয়ানমার থেকে এনে প্রদীপ লাখ লাখ টাকা কামাতেন।

টেকনাফের ওসির দায়িত্বে থাকার সময় প্রদীপের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘টেকনাফের প্রতিটি গ্রামে ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করা হবে। যাদের পাওয়া যাবে না, তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহন সমূলে উৎপাটন করা হবে। তাদের বাড়িতে গায়েবি হামলা হবে। কোনো কোনো বাড়ি ও গাড়িতে গায়েবি অগ্নিসংযোগও হতে পারে।’