২০১৩ সালে পাস হওয়া ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ)’ আইনে প্রথম শাস্তির রায় ঘোষণা করা হলো। সাড়ে ৬ বছর আগে এক গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান থেকে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনিকে পল্লবী থানায় পিটিয়ে হত্যা মামলার রায়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ গত বুধবার ৩ পুলিশ সদস্যকে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- দিয়েছেন। এই ৩ পুলিশ সদস্য হলেন এসআই জাহিদুর রহমান খান, এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু। যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি তাদেরকে এক লাখ টাকা অর্থদ- অনাদায়ে আরো ৬ মাস জেল খাটতে হবে তাদের। অর্থদ- ছাড়াও নিহতের পরিবারকে প্রত্যেক আসামিকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ মামলার বাকি দুই আসামি পুলিশের সোর্স রাসেল ও সুমনকে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদ- এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। আসামিদের মধ্যে এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু এবং পুলিশের সোর্স জামিনে গিয়ে নিরুদ্দেশ রয়েছেন।
থানা হেফাজতে নির্যাতনে মুত্যুপথযাত্রী ইশতিয়াক পানি চাইলে তার মুখে থুথু দেওয়ার ঘটনাকে বিচারক ‘চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলে রায়ে মন্তব্য করেন।
তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ইশতিয়াক হোসেন জনির ভাই, মামলার বাদি রকি। দ-িত আসামিদের দু’জন পলাতক, দেখা গেছে জামিন পেয়ে কিংবা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে আসামিরা বাদিপক্ষের লোকজনকেও সাক্ষীদের হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। আমরা চাই এ মামলায় দ-িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই আইনের অধীনে আদালতে মামলা করতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা উৎসাহ পাবে। মোট কথা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকা উচিত নয়। এই রায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বলগাহীন ক্ষমতার রাশ কিছুটা হলেও টেনে ধরতে সক্ষম হবে। থানা হেফাজতে নির্যাতন করার অভিযোগ প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। পুলিশ নানা অপরাধে লোকজনকে থানায় ধরে নিয়ে আসে, এদের মধ্যে সবাই অপরাধের সাথে যুক্ত এমন নয়, তথাপি তাদের হেনস্তার সম্মুহীন হতে হয়, অনেক সময় ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে অর্থবাণিজ্য চলার অভিযোগ উঠে থানা প্রশাসনের বিরুদ্ধে; আবার অনেক সময় বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই থানায় অকথ্য নির্যাতন চলে কথিত অভিযুক্তদের ওপর। আধুনিক, সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানবিক নির্যাতন একটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বাড়াবাড়ি নিয়ে সোচ্চার হয়, এ ধরনের নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আমরা মনে করি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে জনগণের সেবক ও বন্ধু হিসেবে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতা নিয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা সম্ভব নয়। জনগণের জানমালের হেফাজত তাদের ওপর ন্যস্তÑএর মর্মবাণী আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের অনুধাবন করতে হবে।
মতামত সম্পাদকীয়