সনেট দেব »
সকালের সূর্যের আলো লাগতেই পাড়ার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ বাজারে, কেউ অফিসে, আর ছোট ছেলেমেয়েরা ব্যাগ নিয়ে স্কুলের দিকে দৌড়ায়। সেই দৌড়ের মাঝে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে এক ছোট্ট মেয়ে—তুনু বুড়ি। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি, আর পিঠে বিশাল এক স্কুলব্যাগ। এই ভারী ব্যাগের জন্যই তার মনটা বিষণ্ন হয়ে থাকে সবসময়।
তুনু বুড়ি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সে খুব কল্পনাপ্রিয়। পড়তে ভালোই লাগে, কিন্তু এত বই, খাতা, বোতল, টিফিন—সব মিলিয়ে ব্যাগটা যেন এক পাহাড়সম। হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই সে বলে ওঠে, “ইস! যদি ব্যাগটা নিজেই হাঁটতে পারত… না হয় উড়েই চলত আমার সঙ্গে!”
একদিন বিকেলে তুনু বুড়ি বারান্দায় বসে একা একা কাঁদছিল। তার দাদু এসে পাশে বসলেন। দাদু ছিলেন এক আজব মানুষ—কখনো রূপকথার গল্প বলেন, কখনো গান গেয়ে ফেলেন হঠাৎ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, তুই কাঁদছিস কেন?”
তুনু বুড়ি বলল, “স্কুলব্যাগটা এত ভারী! আমার ইচ্ছা করে এটা উড়ে যাক।”
দাদু একটু হেসে বললেন, “তোর ইচ্ছেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তুই একটা ছড়া গেয়ে ফেলিস জামরুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে। আমি তোকে বলি না—তুই নিজেই বানা। মনের মত। মন থেকে বলা কথাই সবচেয়ে বড় জাদু।”
সেই রাতেই, চাঁদের আলোয় চুপিচুপি তুনু বুড়ি গেল জামরুল গাছটার নিচে। তার ব্যাগটা সে খুলে নিজের সামনে রাখল। বাতাসে পাতা কাঁপছিল, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
তুনু চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করল—
“ওরে ব্যাগ তুই উড়ে যা, ব্যাগের বোঝা আর পারি না।”
গান শেষ হতেই ব্যাগটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। তারপর দুই পাশে খুলে গেল ছোট দুটি ফিতে, আর তার ভেতর থেকে বের হল দুটো ছোট্ট পালকের পাখা! ব্যাগটা ধীরে ধীরে ভেসে উঠল বাতাসে।
তুনু বুড়ির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ব্যাগটা হালকা করে বলল, “তুমি আমায় ডেকেছো, আমি এসেছি। চলো, তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাই!”
পরদিন সকালে, তুনু বুড়ি যখন ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে ব্যাগ পিঠে গেয়ে উঠল, “চলো!” তখন ব্যাগটা ধীরে ধীরে আকাশে উঠে গেল। পাড়ার লোকজন তখনো জানে না, ছোট্ট তুনু বুড়ি আকাশ দিয়ে উড়ে চলেছে তার স্কুলের দিকে।
স্কুলে পৌঁছে বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অহনা আর অনন্যা ছুটে এল তার কাছে। অহনা জিজ্ঞেস করল, “তুই উড়ে এলি? এটা কী করে সম্ভব!” অনন্যা বলল, “তোর ব্যাগে পাখা! ওটা কি অ্যাপ দিয়ে চালাস?”
তুনু বুড়ি হেসে বলল, “জাদু। মনে থেকে চাও, আর গান গাও, তাহলেই ব্যাগ তোমার কথা শোনে।”
সেই রাতে তারা তিনজন মিলে আবার গেল জামরুল গাছের নিচে। সবাই মিলে গাইল নিজের নিজের গান। অহনার ব্যাগে ফুটে উঠল লাল রঙের পাখা, আর অনন্যার ব্যাগে সবুজ। তিনটি ব্যাগ একসাথে ভাসতে লাগল হাওয়ায়।
এই তিন বন্ধুর জাদুর গল্প ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। কিন্তু তারা সব সময় বলে, “উড়ে যাওয়া মজা, কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর যাত্রা হল শেখার যাত্রা।” তাদের ব্যাগ এখন শুধু বই বহন করে না—স্বপ্নও বহন করে।
নীতিশিক্ষা- মন দিয়ে শেখো, মন খুলে ভাবো—তাহলেই জীবন একদিন সত্যিই উড়ে যাবে।