রাজিব শর্মা »
আবারও বেড়েছে লোডশেডিং। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে। নগরীর বাইরে উপজেলাগুলোর চিত্র আরও দুর্বিষহ।
দিনে কখনো লোডশেডিং হচ্ছে দুই হাজার মেগাওয়াট। মূলত বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ, ভারতের আদানির কম সরবরাহসহ অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে জ্বালানি সংকট- এ ত্রিমুখী সমস্যার কারণে বেড়েছে লোডশেডিং।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল দুপুরে ঘুরে দেখা গেছে, নিউমার্কেট, রেয়াজউদ্দিন বাজার, বকসিরহাট, টেরীবাজারসহ বিভিন্ন নিউমার্কেট বিপণিবিতানসহ অলিগলিতে বিদ্যুৎ না থাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে কম বিদ্যুৎ থাকায় থমকে গেছে স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা, কমে গেছে বিক্রিও। তাছাড়া খাতুনগঞ্জের ময়দা, চাল, ডালের ক্রাসিং মিলগুলো অনেকটা বন্ধ রয়েছে। কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে কাজ চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে ।
খাতুনগঞ্জের ময়দা মিল মালিক মো. আজিজুর রহমান বলেন, আগে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা মিল চালু রাখা হতো; এখন তা কমিয়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি চালাতে পারছি না। এসব কারখানা অন্য পদ্ধতিতে চালাতে হলে দ্বিগুণ বেশি খরচ পড়বে। ঐ খরচ সমন্বয় করে আটা-ময়দা বিক্রি করা অসম্ভব।
রাজাখালী চালের মিলের মালিক মো. শামসুর রহমান বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমরা মোটেই কল চালু করিনি। চালু করলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। আপাতত স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রেখেছি।
রেয়াজউদ্দিন বাজারের ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. নূরুল আজিম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ তেমন আসে না। আইপিএস দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় আইপিএসও একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের কাজগুলো বিদ্যুতের উপর নির্ভর করে। অনেকসময় ইলেকট্রনিক্স সার্কিটের কাজ করতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের ফলে কাজের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, ফলে কাজ বন্ধ রাখতে হয়।
বিপণি বিতান এর মুন ফ্যাশনের মালিক রফিকুল নবী বলেন, বুধবার সকাল থেকে চারবার লোডিশেডিং হয়েছে। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ আসে। অন্ধকারে ক্রেতার উপস্থিতি কম। অনেক ব্যবসায়ী লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে।
শাহ আমানত মার্কেটের মোবাইল বাজার এর মালিক রেজাউল করিম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজে হাত দিচ্ছি না। কাজগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, এভাবে লোডশেডিং হলে কাজ করা যাবে না।
তাছাড়া গত কয়েকদিন অসহনীয় গরমের লোডশেডিং এর কারণে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, গত সাড়ে তিন মাস ধরে সামিট গ্রুপের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় দৈনিক এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। বকেয়া পরিশোধ না করায় ভারতের আদানি গ্রুপও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আবার কয়লাসংকটে মাতারবাড়ি এবং এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন কমে গেছে। কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। এছাড়া বকেয়ার কারণে বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এসব কারণে দেশে বিদ্যুতের বড় ঘাটতি তৈরি হয়ে লোডশেডিং বেড়েছে বলে জানান তারা।
বিপিডিবির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম। কিন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট। তবে বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ায় দৈনিক লোডশেডিং করতে হচ্ছে দুই-তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) দৈনিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ সোম থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াট। এ সময় ১৪ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকায় অন্তত দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।
এদিকে আগের তুলনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও সরবরাহ কমে এসেছে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, মঙ্গলবার গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে দুই হাজার ৫৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট। যার ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪২৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। স্বাভাবিক সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে এক হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ আসলেই আমাদের বিদ্যুতের সমস্যাটা থাকবে না। এটা আসলেই আমাদের সমস্যাটা ৯০ ভাগ শেষ হয়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি, হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে এই জিনিসগুলোর অনেকটাই সমাধান হবে।’
‘সামিটের টার্মিনালটি সচল হলেই লোডশেডিং পরিস্থিতি অনেকটা কমে যাবে বলে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কমেছে। যার ফলে লোডশেডিং বাড়ার অন্যতম কারণ এটি। এরপর যদিও আদানি গ্রুপের কিছু বকেয়া আমরা পরিশোধ করেছি। তবুও ওই কোম্পানি থেকে তাদের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে এস আলম বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে, যার কারণে ওখান থেকেও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছি। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ হচ্ছে। এদিকে কারিগরি ত্রুটির কারণে পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়ার। মূলত এসব কারণে বর্তমানে লোডশেডিং বেড়েছে।