সুপ্রভাত ডেস্ক »
পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বাড়ছে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা। এতে স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ইতোমধ্যে শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু—দুটিই মশাবাহিত রোগ। ম্যালেরিয়া হয় অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে আর ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা। ইতোমধ্যে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। খবর বাংলাট্রিবিউন।
তিন পার্বত্য জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত হন পার্বত্য তিন জেলায়। রাঙামাটিতে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ৯০০ জন। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৩২ জনে। একইভাবে রোগী বেড়েছে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।
রাঙামাটিতে আক্রান্তের হার
রাঙামাটির উপজেলাগুলোর মধ্যে জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বরকল ও বিলাইছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ বর্ষা, মশারির কার্যকারিতা কমে যাওয়া ম্যালেরিয়া বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন জেলা সিভিল সার্জন।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে গত মে ও জুন থেকে দ্রুত বাড়ছে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা। দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রকোপ বেশি। যা গত দুই মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর অন্যান্য উপজেলা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে জুরাছড়িতে। বিশেষ করে দুর্গম মৈদং ও দুমদুম্যা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। মৈদং ইউনিয়নের আমতলা, ভুয়াতলীছড়া, জামেরছড়ি ও দুমদুম্যা ইউনিয়নে গবাছড়ি, করইদিয়া, বগাখালী, দুমদুম্যা লাম্বাবাগছড়া, আদিয়াবছড়া গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
রাঙামাটির উপজেলাগুলোর মধ্যে জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বরকল ও বিলাইছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে দুমদুম্যা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গোবাছড়ি, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের করাইছড়ি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বগাখালী, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দুমদুম্যা ও আদিবছড়িতে সববেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সহজে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয় না চিকিৎসকদের। এসব স্থানে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ দিন। সীমান্ত সড়ক হওয়াতে বগাখালী, দুমদুম্যা ও আদিবছড়িতে মোটরসাইকেলে যাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে জেলা শহরে আসতেও গুনতে হয় হাজার টাকা। আবার বিলাইছড়ি উপজেলা দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে মোটরসাইকেলে যাওয়া যায়। তবে বৃষ্টি হলে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ম্যালেরিয়া রোগে ১৭ হাজার ৪৫, ২০১৮ সালে দুই হাজার ৯৯৩, ২০১৯ সালে ছয় হাজার তিন, ২০২০ সালে এক হাজার ৩৭৭, ২০২১ সালে এক হাজার ৬০০ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে ২৭, জুনে ১৫৯, সবমিলিয়ে ওই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৭৭৯ জন আক্রান্ত হন। চলতি বছর মার্চে ৫৫, এপ্রিলে ৭৯, মে-তে ২৩৩ ও জুনে ২৩৬ জনের ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়। এর মধ্যে জুনে দুমদুম্যা ইউনিয়নে ১৬৫ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।
জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসে ২৭, জুনে ১৫৯ জন আক্রান্ত হন। সবমিলিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৭৭৯ জন।
দুমদুম্যা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাধন কুমার চাকমা বলেন, ‘ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সে জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকসহ ইউনিয়ন পরিষদ সম্মিলিতভাবে সমন্বয় করে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কাজ করার উদ্যোগ না নিলে এটি আরও ছড়িয়ে পড়বে।’
জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অনন্যা চাকমা বলেন, ‘ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ব্র্যাক থেকে বিনামূল্যে মশারি দেওয়া হয়। এর মেয়াদ থাকে তিন বছর। তৃতীয় বছর হওয়ার কারণে এবার মশারি কার্যকারিতা কমে গেছে। তাই ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা দুর্গম এলাকাগুলোতে বেড়েছে। এ বছর নতুন করে দুই হাজার ৩৫০টি মশারি বিতরণ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় ম্যালেরিয়া প্রবণতা বেশি সেখানে স্বাস্থ্যকর্মী ও ব্র্যাকের কর্মীরা কাজ করছেন।’
খাগড়াছড়ির চিত্র
খাগড়াছড়িতে ডেঙ্গুর চেয়ে দ্রুত বাড়ছে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা। গত ১ জুন থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮৬ জন। এর মধ্যে ম্যালেরিয়ায় ১২১ এবং ৬৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই হিসাবে জেলায় ডেঙ্গুর চেয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী প্রায় দ্বিগুণ।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, জুন মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ জন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২১ জন। চলতি মাসের ১১ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিনে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ৫০ জন আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৪৪ জন। তবে চলতি বছর ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ায় এখনও কেউ মারা যাননি।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জুন মাসের শেষ সময় থেকে মাটিরাঙ্গা, গুইমারা উপজেলা ডেঙ্গুর হট স্পটে পরিণত হয়েছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগ মাটিরাঙ্গা পৌরসভা এবং গুইমারার জালিয়াপাড়ার। ইতিমধ্যে মাটিরাঙ্গা পৌর এলাকাকে ডেঙ্গুর হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি আক্রান্তরা সদর হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন।
মাটিরাঙ্গার নতুন পাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছোট ভাই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহ ধরে সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভাইয়ের কষ্টের শেষ নেই। দায়িত্বশীলরা এতদিন বলেছেন, পার্বত্য এলাকা থেকে ম্যালেরিয়া বিদায় নিয়েছে। তাহলে এখন কোথা থেকে এলো? এখন অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
আক্রান্তদের স্বজনরা বলছেন, দিন-রাত সবসময় মশার উপদ্রুব দেখা যাচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না করা এবং মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
তবে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র শামছুল হক বলেছেন, ‘মশা নিধনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃষ্টির কারণে কিছু স্থানে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’
বর্ষা মৌসুমে মশার উপদ্রব বেশি হওয়ায় ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানালেন মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা. মিটন ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সবার বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সেইসঙ্গে রাতে মশারি লাগিয়ে ঘুমাতে হবে। সবাইকে এ নিয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।’
স্থানীয়দের অসচেতনতার কারণে মাটিরাঙ্গা এবং গুইমারায় বেড়েছে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা—এমনটি জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা। তিনি বলেন, ‘যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা, বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার না রাখা এবং জমানো পানি অপসারণ না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিষয়ে সচেতন হলে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসবে।’
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে উল্লেখ করে জেলা সিভিল ডা. মোহাম্মদ ছাবের বলেন, ‘আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি অন্যদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে মশারি ব্যবহারের পাশাপাশি নিজেদের বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বলছি আমরা।’
বান্দরবানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ
বান্দরবানের দুর্গম থানচি উপজেলার কয়েকটি এলাকায় দেখা দিয়েছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছেন দুই জন। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অর্ধশতাধিক। বর্ষার শুরু থেকে পাহাড়ে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। এতেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়েছে বলে জানালেন চিকিৎসকরা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, থানচি সদর, রেমাক্রী ও তিন্দু ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়ায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক। গত কয়েকদিনে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০ জনের বেশি রোগী। ইতোমধ্যে ম্যালেরিয়ায় এক শিশুসহ মারা গেছেন দুই জন।
চিকিৎসক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষার শুরুতে পাহাড়ে থেমে থেমে বৃষ্টিপাতে পানি জমে মশা বেড়েছে। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা। এসব দুর্গম এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিওকর্মীরা মশারি এবং ওষুধ বিতরণ করেছেন। তবু বেড়ে চলছে আক্রান্তের হার।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত (১৩ জুলাই) জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৯৩৩ জন। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মা সে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৬৯৩ জন। জেলায় বর্তমানে শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চলতি মাসে থানচিতে একজন ও রুমায় একজন মারা গেছেন ম্যালেরিয়ায়। থানচির রেমাক্রী এলাকার জুম চাষি মা মেচিং মারমা বলেন, ‘জুম চাষ করতে গেলে মশা কামড়ায়, রাতে বাসায় ঘুমালেও মশা কামড়ায়। দুই দিন ধরে আমার ও মেয়ের জ্বর। হাসপাতালে আসার পর ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়। এখন চিকিৎসা নিচ্ছি।’
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্তদের ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ। তিনি বলেন, ‘সব ম্যালেরিয়া রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছি। যারা দুর্গম এলাকায় আছেন, তাদের সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের গর্ত ও ঝিরির পাশে জমে থাকা পানিতে মশার জন্ম হচ্ছে। দুর্গম এলাকার মানুষ সচেতন না হওয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর চেয়ে ম্যালেরিয়া রোগী বেশি। এর মধ্যে থানচির রোগী বেশি। সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো হয়েছে।’