সুপ্রভাত ডেস্ক »
নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার ক্ষেত্রে আরও সময় নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদা।
কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিদায় লগ্নে আকস্মিকভাবে নতুন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে পাসের তোড়জোড়ের মধ্যে এই মত জানালেন তিনি।
সরকার প্রণীত খসড়া আইনে অপূর্ণতা দেখার কথাও জানিয়েছেন ২০০৭ সালে গঠিত ইসির নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক সচিব শামসুল হুদা।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হলেও তা একটি আইনের অধীনে হবে বলে উল্লেখ করা আছে।
গত ৫০ বছরেও সেই আইন না হওয়ায় বরাবরই নির্বাচন কমিশন গঠনে দেখা দেয় বিতর্ক। তা এড়াতে গত দুই বার সার্চ কমিটি গঠন করে নিয়োগের একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও বিতর্ক থামেনি।
ইসি নিয়োগের আইন প্রসঙ্গে এক মাস আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এবার তা সম্ভবপর হচ্ছে না। আগের মতো সার্চ কমিটি গঠন করেই ইসি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।
এরপর রাষ্ট্রপতি ইসিতে নিবন্ধিত সংলাপ শুরু করলে তাতে আইন করার বিষয়টি জোরাল হয়ে আসে।
সংলাপ শেষের পরপরই গত সোমবার মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত আইনটি অনুমোদিত হয়। তা রোববার সংসদে উত্থাপন করবেন আইনমন্ত্রী।
এই প্রক্রিয়া চলার মধ্যে শনিবার ঢাকায় এফডিসিতে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে’ শীর্ষক ছায়া সংসদে তা নিয়ে কথা বলেন শামসুল হুদা।
সাবেক এই সিইসি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাজ ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেন বলে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
তিনি বলেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশন সদিচ্ছা থাকলে ভালো নির্বাচন করতে পারত। তাদের পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয়।”
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সুখকর না হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়েছে,” বলেন নির্দলীয় সরকারের অধীনে গঠিত ইসির প্রধান শামসুল হুদা।
প্রস্তাবিত আইনে অপূর্ণতা দেখার কথাও বলেন তিনি।
“নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রস্তাবিত খসড়া আইনে মনে হচ্ছে অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এটি শুধু সার্চ কমিটি গঠনের জন্য।”
গত দুই বার অনুসৃত সার্চ কমিটি এবার আইনি ভিত্তি পাচ্ছে বলে মন্ত্রিসভায় খসড়া অনুমোদনের পর জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
এই আইনের অধীনেই পরবর্তী ইসি নিয়োগ হবে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফলে তার আগে নতুন কমিশন গঠনের জন্য এক মাসও সময় নেই।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি না করার পরামর্শ দিয়ে শামসুল হুদা বলেন, “এই আইনটি যাতে জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একটি ভালো আইনের জন্য প্রয়োজনে সময় নেওয়া যেতে পারে। তাড়াহুড়া করে ত্রুটিপূর্ণ আইন প্রণয়ন কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।
“প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অযোগ্যতার সুষ্পষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে। যাদের সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে বিবেচনায় না নেওয়া উচিৎ।”
ইসির কেউ দুর্নীতিতে জড়ালে তার বিচারের বিধানও আইনে রাখার সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনাররা কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে তাদের আইনানুগ বিচার হওয়া উচিত। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তাই কোনো বিশেষ পদধারী ব্যক্তির অপরাধের বিচারের জন্য ইনডেমনিটি থাকা উচিত নয়।”
সবার মতামত নেওয়ার উপর জোর দিয়ে শামসুল হুদা বলেন, “সত্যিকার অর্থে বর্তমান সংসদে জনপ্রতিনিধিত্ব নেই, তাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে ইসির নিয়োগের প্রস্তাবিত আইন নিয়ে ছয়টি দফা সুপারিশ করা হয়।
♦ ইসি গঠনে সার্চ কমিটিতে সংসদে সরকারি দল, বিরোধী দল ও সংসদ সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে তৃতীয় প্রতিনিধিত্বকারী দলের এক জন করে সংসদ সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত কর।
♦ নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে সম্পৃক্ত সুশীল সমাজের ব্যাক্তি, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ইসি গঠনে তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা।
♦ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণের মেকানিজম আইনের অন্তর্ভূক্ত রাখা।
♦ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সার্চ কমিটি যেসব ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে, সেসব নাম ও তাদের জীবনবৃত্তান্ত ওবেসাইটে প্রকাশ করা। যাতে তাদের সম্পর্কে গুরুতর কোন অভিযোগ থাকলে তা নাগরিকরা জানাতে পারে।
♦ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনাররা আর্থিক অনিয়ম, অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ততা এবং পক্ষপাতমূলক নির্বাচন করলে কী ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য হবে নির্বাচন কমিশন আইনে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা উল্লেখ করা।
♦ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অনিয়ম বা অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে কোন রকম বিশেষ শিথিলতা বা ইনডেমনিটির বিধান না রাখা।
অনুষ্ঠানে শামসুল হুদা বলেন, “গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন খুবই জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সুশাসন ব্যাহত হয়।”
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনলোজির বিতার্কিকদের পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ জয়ী হয়। এতে বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক আরাফাত আলী সিদ্দিক ও আতিকা রহমান।
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম