হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ওয়া আলা, সমস্ত প্রশংসার হকদার, যিনি সৃষ্টির লালনÑপালনের জন্য রিয্ক’র বন্দোবস্ত করেছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি ইবাদতের জন্য ‘পবিত্রতার’ শর্তারোপ করেছেন, এমন কি খাওয়াÑপরার জন্যও পবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পবিত্রতাকে ভালবাসেন কৃতজ্ঞতা সে আল্লাহ্র প্রতি, যিনি আমাদেরকে উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন। অকৃতজ্ঞকে তিনি পছন্দ করেন না।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক, সমকক্ষ, সমগোত্র বলতে কিছু নেই। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের কর্ণধার পথদ্রষ্টা সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল, যিনি সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। যাঁর অনুপম, পবিত্র জীবনাদর্শকে মহান আল্লাহ্ ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ্’ বলেছেন।
আমরা জানি, সূর্যের উদয়Ñঅস্তে দিন’র পরিবর্তন ঘটে। তেমনি চাঁদের উদয়Ñঅস্ত দ্বারা মাস পরিবর্তিত হয়। রবিউল আখের গত হয়ে শুরু হয়েছে মাহে জুমাদাল উলা। এভাবেই আমাদের প্রত্যেকেই একদিন দেখব, আমাদের নির্ধারিত আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে, নিভে গেছে জীবন প্রদীপ। যদিও মনে হয়, আমি অনেকদিন আছি। কিন্তু সে ভাবনাÑমরীচিকার মত। স্বল্প জীবনকালে এ মুহূর্তগুলো দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু। তাই বুদ্ধিমানেরা প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগান। বিশ্বÑব্রহ্মা-ের বিগত ইতিহাসে বারে বারে এ কথাটি স্বীকৃত হয়েছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের মহাপুরুষ। অতি অল্প সময়ে তিনি এক বিশৃঙ্খল, উগ্র, দুঃসাহসী জনগোষ্ঠীকে সুন্দর এক মহান আদর্শে সুসংহত, সুসংগঠিত করতে সক্ষম হন।
আমাদের পেয়ারা নবীর পবিত্র নাম মুবারক মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মর্যাদার সর্বশ্রেষ্ঠ আর সর্বোচ্চ মকামে মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর পবিত্র নাম’র অর্থ ‘যিনি চরম প্রশংসিত’। সেই চরম প্রশংসিত সত্তা, সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের মূর্তপ্রতীক, খোদার মূর্ত করুণা, রহমাতুল্লিল আলামীন (দ.) সর্বপ্লাবী প্রভাবের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে প্রভু বা রাজা বলে প্রচার করেন নি। তিনি অনুসারীদের কাছে বিনয়ের শিক্ষা দিতে গিয়ে যে মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন, তাতে নিজ পরিচয় বিবৃত করেছেন ‘আবদুহু’। অর্থাৎ প্রভুর সার্বক্ষণিক অনুগত বান্দা। নিজ অনুসারীদের ‘অনুচর’ না বলে ‘সহচর’ বলে অনাগতকালব্যাপী উম্মতের অন্তরে পরম শ্রদ্ধার আসনে বরেণ্য করে দিয়েছেন। জালিম বাদশাহ্গণ নিপীড়ন পূর্বক প্রজাদের তন (দৈহিক অস্তিত্ব) অধিকৃত করেছেন। পক্ষান্তরে রাসূলে আরবী, প্রিয়নবী, করুণার ছবি, রহমতে দোÑজাঁহা, সরওয়ারে কওন ও মাকা তাঁর অনুগত, বিশ্বাসী উম্মতের মন জিতে নিয়েছেন। মক্কা শরীফ ৮ম হিজরীতে বিজিত হয় বিনা বাধায়। যারা নিজ মাতৃভূমি থেকে তাঁর নিষ্ক্রান্ত হবার কারণ হয়েছিল। তিনি প্রতিশোধ নেয়ার স্থলে তাঁদের জন্য উদাত্ত ক্ষমার ঘোষণা জারি করেন। যার ফলে আবু সুফিয়ান’র মত চরম শত্রুরও মানসিক পরিবর্তন ঘটে যায়। চিরদিনের লালিত বিশ্বাস, শত্রুতা, ঘৃণাÑসব সরে গিয়ে মনের জগতে ঘটে অভাবনীয় বিপ্লব। তারা মেনে নেয় এঁকে ঘৃণা করা যায় না, ভালবাসতে হয়। এঁকে শত্রু ভাবা যায় না; বরং সশ্রদ্ধে হৃদয়Ñসিংহাসনে বরণই করতে হয়। সংঘর্ষ নয়, তাঁর মমতার ডোরে নিজকে বন্দি করতেই মন শুধু বিচলিত হয়। তাঁর নিন্দা করা যায় না; বরং প্রশংসার বরণডালা দিয়ে তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। তাঁর এ নাম সার্থক, স্বয়ং আল্লাহরই তাঁর নাম স্থির করেছেন ‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ শত্রুÑমিত্র নির্বিশেষে যেÑই তাঁর নাম ধরবে স্বেচ্ছায়Ñঅনিচ্ছায় সে নবীজির প্রশংসাই করবে। নামের অর্থ তাঁর পবিত্র জীবনে ষোল আনাই মূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি অনিন্দ্য, কলুষমুক্ত।
পবিত্র কুরআনে এ পবিত্র নামটি চারবার উল্লেখ হয়েছে। সে নামে নামাঙ্কিত কুরআনের ৪৭তম সুরার নাম সুরা মুহাম্মদ। এর ২য় আয়াতে একবার এ নাম উক্ত হয়। এছাড়াও সুরা আ’লে ইমরানÑএর ১৪৪তম, সুরা আহযাব’র ৪০তম, এবং সুরা ফাৎহের সর্বশেষ (২৯তম) আয়াতে এটির উল্লেখ আছে। এ আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসূল। আর যাঁরা তাঁর সাহচর্যে আছেন, তাঁরা কাফিরদের প্রতি কঠোর, পরস্পরের মধ্যে দয়াপরবশ, আপনি তাঁদেরকে দেখবেন রুকুকারী, সাজদাবনত অবস্থায় আল্লাহ্র কাছ থেকে তাঁর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি তালাশ করে। তাঁদের চেহারাসমূহে সাজদার আলামত দীপ্তিমান হবে। তা হলো তাওরাত গ্রন্থে বর্ণিত তাঁদের উদাহরণ, ইন্জীলÑএ বর্ণিত তাঁদের গুণাবলী’।
বর্ণিত কথাগুলো সুরা ফাত্হের সর্বশেষ আয়াতের আংশিক’র অনুবাদ। এতে রাসূলুল্লাহ (দ.) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম’র গুণ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা, যা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে বিদ্যমান। নবীজির শানÑমান বর্ণনা করে কখনো শেষ করা যাবে না। তা কস্মিনকালেও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যাঁর সাহাবীদের গুণগানে আসমানী গ্রন্থসমূহ মুখর, তাঁর গুণাবলী কীভাবে সম্পন্ন করা যাবে? ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। যে মহান সত্তার সান্নিধ্যে এসে দুর্ধর্ষ মানুষগুলো ক্রমশ এমন সোনার মানুষে পরিণত হয়, তিনি কেমন সে পরশমণি! যে আল্লাহ্র জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি সকল হামদ’র একচ্ছত্র মালিক, সেই সর্বশক্তিমান ¯্রষ্টাই তাঁর নাম স্থির করেছেন মুহাম্মদ। যিনি আঠার হাজার মাখলুকাত’র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, তিনিই তাঁর প্রিয়তম এ সৃষ্টিকে করেছেন সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। ‘হামদ’ বা প্রশংসার নিজে একচ্ছত্র দাবিদার হয়েও তিনি ‘সৃষ্টির রহমত’ নবীর নাম রাখেন মুহাম্মদ। যে নামের অর্থ হলো, যিনি অনবরত প্রশংসিত হতেই থাকবেন। চরম প্রশংসিত সত্তাই মুহাম্মদ। কাফেরদের কেউ একজন একবার অনেক চিন্তাÑভাবনা করে বলল, আমরা কত নির্বোধ, আমরা কেউ তাঁকে স্বীকার করছি না; বরং প্রত্যাখ্যান করছি। অথচ তাঁকে ‘মুহাম্মদ’ (চরম প্রশংসিত) বলে ডেকে যাচ্ছি। এবার থেকে তাঁকে আমরা ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলে ডাকব। নাউযুবিল্লাহ। এ কথা প্রিয়নবীর কানে আসলে তিনি বললেন, তাদের কেউ ওই নামে থাকতে পারে। সে আমি নই। আমাকে তো আল্লাহ্ তাআলা ‘মুহাম্মদ’ বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।
আমাদের প্রিয় নবীর নাম মুবারকের মধ্যে চারটি বর্ণ, তন্মধ্যে দু’টির ‘মীম’ হরফ রয়েছে। যা উচ্চারণের সময় উভয় ঠোঁট মিলিত হয়ে যায়। মুহাব্বতের চরম প্রকাশে আমরা দু’ ঠোঁট একত্র করি। যেমন চুম্বনের সময়। পৃথিবীর যত নামই থাকুক, এই নামের চেয়ে মধুরতর নাম আর নেই। তাই আল্লাহ্ তাআলার কাছে এ নাম অতি প্রিয়। প্রিয় বলেই কালেমা শরীফে নিজের নামের পাশে প্রিয়তম বান্দার এ নামটি তিনি যুক্ত করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে একমাত্র সেতুবন্ধন। আল্লাহ্ ¯্রষ্টা, তাঁর জালালী নাম মুবারক ‘আল্লাহ’। এটা উচ্চারণের সময়ে দু’ঠোঁট আলাদা থাকে। আল্লাহ্র একান্ত ও সরাসরি সান্নিধ্য ও নৈকট্যে উপনীত হবার সাধ্য আমাদের কারো নেই। এ অনতিক্রম্য দূরত্বে পৌঁছার জন্য তিনি শুধু একজনকেই বেছে নিয়েছেন। সেই গন্তব্যে তিনি যাঁকে নিয়ে গেছেন, তিনি আমাদের নবী লাÑমকানের মেহমান, হাবীবে রহমান, রহমতে দো জাহান, সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাই সেই লাÑমকানের খোদার সাথে সম্পর্কিত হতে হলে তাঁর সাথে নিবিড়তর সম্পর্কে বিকল্প নেই। লক্ষণীয় যে, তাঁর নাম মুবারক জপতে গেলে উপরের ও নিচের ঠোঁটের সংযোগ হয়ে যায়। এটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত যে, ওয়াজিবুল ওজুদ মহান আল্লাহ্র সাথে মুসকিনুল ওজুদ বান্দার যোগাযোগের একমাত্র অপরিহার্য ও নিশ্চিত মাধ্যম হলেন হুযূর রাহ্মাতুল্লিল আলামীন। এ যোগসূত্র অর্জনে সক্ষম হবার জন্য প্রিয়নবীর সাথে অকৃত্রিম ও নিবিড় মুহাব্বতের সম্পর্ক জরুরি। নচেৎ এ সৌভাগ্য অর্জন করা অসম্ভব।
সাহাবায়ে রাসূল’র সেই ‘হুব্বে মুস্তফা’ (নবীপ্রেম)র কোন তুলনা হয় না। নবীজির নাম মুবারকের প্রতি তাঁদের ভক্তিÑপ্রেমের অন্ত নেই। একবার সাহাবা পরিবেষ্টিত হয়ে আল্লাহ্র হাবীব মসজিদে নবভীতে বসা অবস্থায় হযরত বেলাল (রাদ্বি.) আযান দিচ্ছেন। যখন ‘আশহাদু আল্লা মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ ধ্বনিত হলো, তখন নবীজির একান্ত সহচর, শ্রেষ্ঠতম অশেক আবু বকর সিদ্দীক (রাদ্বি.) নিজ বৃদ্ধ আঙ্গুলদ্বয়ে চুমো দিয়ে পরম শ্রদ্ধায় দুটি চোখে দু’ বৃদ্ধাঙ্গুলি অঞ্জন টেনে দিলেন। আযান শেষে এক সাহাবী এটা নবীজিকে জানালে নবীজি ইরশাদ করলেন, আমার এ আশেক সাহাবীর আমল যে উম্মত পালন করবে, কিয়ামতের কাতার হতে আমি তাঁকে খুঁজে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবো’। (সূত্র : আল্লামা ইসমাঈল হক্কীকৃত রূহুল বয়ান, মোল্লা মুঈন কাশেফীকৃত মাআরেজুন নুবুওওয়াহ) এটা সাহাবীগণের নবীপ্রেমের একটু ঝলক। যাঁরা তাঁর জন্য প্রাণকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতেন।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।