সাগর আহমেদ »
১৯৭১ সাল, মে মাস , বিকেল বেলা। মুন্সীগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মুক্তারপুর অঞ্চল। এখনকার মতো ওই এলাকাটা এতোটা শহুরে হয়ে ওঠেনি। তপুর বাবা ইসহাক মিয়া তার মুদি দোকানে বসে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্র অনুষ্ঠানটি শুনছে। দোকানের একটু পেছনে বামদিকে তাদের বাড়ি। ইসহাক মিয়ার বড় ছেলে অপু গতমাসে মুক্তিযুদ্ধে গেছে।তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন । তপুর বড় বোন সিনথিয়া মায়ের সাথে বসে শিং মাছ কুটছে। তপু তার লাল রংয়ের ঢাউস ঘুড়ি আর নাটাইটা বের করলো । তপু কিশোর বয়সী, খুব চঞ্চল। ঘুড়ি ওড়ানো ওর খুব নেশা । মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ঘুড়ির কাটাকাটি খেলায় মাতে। তবে এ পর্যন্ত তপুর ঘুড়ি কেউ কাটতে পারেনি। সে বের হতে যেতেই সিনথিয়া পেছন থেকে ডেকে ওঠলো,
‘তপু তুই কই যাস? একদম বাইরে যাবি না। আজ সন্ধ্যায় ছোট খালা আসবে। তুই ঘরটা গুছিয়ে রাখ।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা, বোনের দিকে একটা ভেংচি কেটে তপু দৌড় দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিনোদপুরে বড় বড় মাছের আড়ত । তারপাশেই বিশাল খোলা মাঠ। তপুর বন্ধু রবিন, লেনিন, রাসেল আর রিশাদ আগেই সেখান হাজির হয়েছে । তপু দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে এসে হাজির হলো । কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা । তপু আর তার বন্ধুরা আকাশে উড়িয়ে দিলো লাল, নীল সবুজ রংয়ের বড় বড় ঘুড়ি। রোদ মাখা বিকেল। মৃদু মন্দ হাওয়া। চলছে ঘুড়ি কাটাকাটির তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রথমে তপু সুযোগ পেয়ে রিশাদের সবুজ ঘুড়িটা কেটে ফেললো । খুশিতে হেসে বললো ,‘তোরা আমার সাথে পেরেছিস কখনো?’ লেনিন বললো,‘এত গর্ব করিস না, তপু। একদিন তোকেও হারতে হবে া’
একটু পরেই দমকা বাতাস উঠলো । তপুর লাল রংয়ের ঘুড়িটা একটু কাত হয়ে গেলো ।আর সাথে সাথেই রাসেল সুযোগ বুঝে তপুর ঘুড়ির সুতোটা দিলো কেটে। তপু দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। ভাবলো, এমনতো হয় না, তারমনে কু ডেকে উঠলো । তপু কারো সাথে কথা না বলে নাটাইটা নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলো । পাক বাহিনীর কয়েকটা জিপ মুন্সীগঞ্জ সদর থেকে বের হয়ে মুক্তারপুরের দিকে এগিয়ে চলছে। তাদের কাছে খবর আছে মুক্তারপুরে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি ঘর আছে । তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই এই অভিযান। গ্রামে ঢোকার মুখেই ইসহাক মিয়ার দোকান । ইসহাক মিয়া তখন রেডিওতে বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর শুনছিলো । হঠাৎ এক গাড়ি পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার মোখলেস শেখ সেখানে এসে হাজির হলো। মোখলেস শেখ দেখিয়ে দিতেই তিনজন পাকিস্তানী সৈনিক ইসহাক মিয়াকে জামার কলার ধরে টেনে রাস্তায় নামালো । একজন সৈন্য চিৎকার করে উঠলো, ‘বোল, মুক্তি কেয়া হ্যায়?’
ইসহাক মিয়া চুপ করে রইলো। রাজাকার মোখলেস শেখ বললো, ‘ওর বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে হুজুর। আর এই ইসহাক মিয়ার কথায় গ্রামের আরো অনেক যুবক ছাওয়াল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। ওকে খতম করুন হুজুর । পাকবাহিনীর কমান্ডার এবার চিৎকার করে উঠলো, ’বোল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।” ইসহাক মিয়া সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘জয় বাংলা’।
পাক কমান্ডার তৎক্ষণাৎ ইসহাক মিয়াকে ব্রাস ফায়ার করলো । ইসহাক মিয়ার রক্তাক্ত শরীর বাংলার পবিত্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রাজাকার মোখলেস ও কয়েকজন পাক সেনা ততক্ষণে ইসহাক মিয়ার বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে প্রথমেই তপুর মা মমতাজ বেগমকে গুলি করলো। সিনথিয়া ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলো । পাক সেনারা তাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনলো। তারপর তাকে জিপে উঠিয়ে চলে গেল মুন্সীগঞ্জ সদর হেড ক্যাম্পে। তপু বাড়ির কাছে পৌঁছতেই দেখে অনেক লোকজনের ভিড়। সে দেখলো বাবার রক্তাক্ত লাশ দোকানের সামনে পড়ে আছে । ঘরের দরজা ভাঙা । ভেতরে ঢুকতেই দেখে মায়ের লাশ । প্রতিবেশীরা বললো , ওর বোনকে পাক বাহিনীর লোকজন তুলে নিয়ে গেছে । তপুর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ও ঝরলো না । সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো দেশ স্বাধীন করে, শত্রুদের নিজ হাতে যতো জনকে পারে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে ।
তপু সেখানে আর দাড়ালো না। সোজা চললো চর ডুমুড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে । সেখানে একমাস প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে। ওদের কমান্ডার ছোটন চৌধুরী অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি পাকিস্তানী বাহিনীকে নানা কৌশলে ধ্বংস ও নাজেহাল করে থাকেন । ছোটন চৌধুরী একদিন খবর পেলেন , সদরঘাট থেকে অস্ত্র বোঝাই পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ মুন্সীগঞ্জের দিকে আসছে। সাথে সাথে তিনি কমান্ডো অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন । লঞ্চটিকে মুক্তারপুর ঘাট থেকে দূর থেকে দেখা যেতেই তপুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাথায় কচুরিপানা বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগলো । লঞ্চটি কাছে আসতেই তপুরা লঞ্চটির কাছে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো । লঞ্চটির নিচে তিনটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বেঁধে তারা ফিরে আসতে লাগলো । এমন সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা ভুল করে দম নিতে একটু মাথা জাগাতেই , পাকবাহিনীর লোকজন গুলি করা শুরু করলো । একে একে মারা গেলো সকল মুক্তিযোদ্ধা । তপু কিন্তু ডুব সাঁতার দিয়ে প্রায় ধলেশ্বরীর পাড়ে পৌঁছে গেলো । এমন সময় দুটি ঘটনা ঘটলো একজন পাক সেনার গুলি তপুর বুকে এসে বিদ্ধ হয়ে নদীর পানিকে লাল করে তুললো এবং পাক বাহিনীর লঞ্চটিতে বিস্ফোরণ ঘটলো । লঞ্চটি অত্যন্ত দ্রুত ডুবতে লাগলো। দেশকে ভালোবেসে শত্রু ধ্বংস করতে করতে কিশোর তপুর মৃত্যু হলো । একটি সুন্দর ও কল্যানকর দেশের প্রত্যাশায় তপুসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা তাদের অমূল্য প্রাণ দিয়ে গেছেন । আমরা যেনো তাদেরকে এবং তাদের প্রত্যাশাকে ভুলে না যাই।