হোসাইন আল-নাহিদ :
রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখের মেলা।
তপুর আজ যেন কোনোভাবেই দিনটা কাটছে না। প্রতিক্ষণ যেন এক-একটা শতাব্দীর মতো বড় বড় মিনিট হচ্ছে।
পুরো সময়টা অস্থির লাগছে তার।
রাত যেন আরো বিশাল, কতবার যে ঘুম থেকে ওঠে মাকে ডেকে বলেছিল, ‘মা দেখো তো সকাল হলো কিনা, কখন সকাল হবে আর কতক্ষণ রাত আছে?
মা তো অস্থির হয়ে বকা দেওয়া শুরু করেছে!
সেদিন তপু ঘুমাই ই নাই সারারাত, সাথে মাকেও ঘুমাতে দেয়নি।
তপু এবার মেলার জন্য পণ করেছে, সকালে উঠেই সবার আগে গোসল করে রেডি হবে, খাওয়া-দাওয়া করলে করবে, না করলে নাই।
বাবা তপুর পছন্দের সবুজ পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে এসেছে। সেটা পরেই দেবে ভোঁ দৌড়। এক দৌড়ে একদম মেলায়।
মোটকথা, সবার আগে মেলায় যাবে, মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়বে, পান্তা-ইলিশ খাবে, সারাদিন ঘুরবে।
সাথে মাটির জিনিষপত্র কিনবে, বাঁশি ঢোলগাড়ি এগুলো তো আছেই।
তপু বৈশাখী মেলা করবে ভেবেই অনেকদিন আগে থেকেই টাকা জমিয়েছিল।
বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে যাউন ছব (একধরনের মশলা)-এর গাছ কুড়িয়েছিল। সাথে ভেন্নার বীজ (একধরনের তৈলবীজ) কুড়িয়েছিল।
যাউন ছব হয়েছিলো ৬ কেজি এবং ভেন্না বীজ হয়েছিল ৩ কেজি। এটাই তার মূল সঞ্চয়। যাউন ছব বিক্রি করেছিল ২৫ টাকা কেজি এবং ভেন্না ৫০ টাকা কেজি। সর্বমোট : ২৭০ টাকা!
আরো পণ আছে বাবার কাছ থেকে ২০০ টাকা নেবে। মায়ের কাছ থেকে নেবে ১০০ টাকা, নানা-নানির থেকে নেবে ৫০+৫০ = ১০০ টাকা। সবার কাছে গিয়ে চাঁদা তুলেও টাকা হয়েছে ৬৭০ টাকা।
এখন মেলায় যাওয়ার পালা!
এর মাঝে তপুর ছোটভাইও পিছু নিয়েছে মেলায় যাবে। তাকে ওপরের বাড়তি ৭০ টাকা দিয়ে কোনোরকম এ যাত্রায় বেঁচেছে।
তপু এখন একা একাই মেলায় চলছে।
এখন টাকা রয়েছে তার কাছে ৬০০ /=
তপুর কি যে আনন্দ লাগছে, ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য নাই কারো। মলায় গিয়ে অনেক আনন্দ করবে সে। সারাদিন ঘুরবে। অনেক সখের জিনিসপত্র কিনবে।
তপু মেলায় যাওয়ার রাস্তায় হাঁটছে আর টাকা ভাগ করে নিচ্ছে কয় টাকায় কি কি কিনবে।
পান্তা-ইলিশ ১০০ টাকা পে¬ট নেয়। গিয়েই আগে পান্তা-ইলিশ খাবে।
৫০ টাকা দিয়ে একটা ঢোল কিনবে। ১০০ টাকায় ব্যাটবল কিনবে।
৫০ টাকা দিয়ে একটা রঙিন চশমা নেবে।
মাটির জিনিস ও বাঁশি কিনবে, সেখানে ধরে রাখলো ১০০ টাকা । টিকিট কেটে পুতুল খেলা দেখবে। মঞ্চনাটক দেখবে। নাগরদোলায় চড়বে। সেখানে খরচ হবে ১০০ টাকা।
বাকি ১০০ টাকা দিয়ে বাড়ির জন্য সাজ্জনা মিষ্টি এবং গুড়মিশ্রিত মুড়ি কিনবে।
অনেক দর কষাকষি ও হিসাব করে মেলায় যাচ্ছে সে। মনটাই অন্যরকম আনন্দে ভরপুর।
যাওয়ার পথে কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা হলো তপুর।
সবার প্ল্যান শুনে নিল, কে কি করবে, কি কিনবে।
সবার চেয়ে তপুর পকেটে টাকা বেশি। তপুর আনন্দ সবার চেয়ে আরো বেশি।
তপু এবং তার বন্ধুরা নৌকায় করে মেলায় গিয়েছে। নৌকা থেকে নেমেই দেখলো, এক এক রকমের দোকান সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা।
দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
মেলায় যাবে এমন সময় একপাশে অনেক লোকের ভিড় জমে আছে। কৌতূহলের বশে সেখানে তপু এবং তপুর এক বন্ধু যায়।
গিয়ে খেয়াল করলো, ফিতে দিয়ে একধরনের বাজিখেলা চলছে। ওখানে ৫০ টাকা ধরলে ১০০ টাকা দেয়। ১০০ ধরলে ২০০ আর ২০০ ধরলে ৫০০ টাকা বাজি।
খেলাটার নিয়ম হচ্ছে ফিতা পেঁচিয়ে দেবে তিনটা, গোল মাথা থাকবে। ওখানে একটা কাঠি দিয়ে যেকোনো একটা গোল মাথায় বসাতে হবে। তারপরে ফিতে টান দেবে যদি ফিতের সাথে কাঠি আটকে যায়, তবে অপরজন বাজিতে জিততে পারবে, না আটকালে হেরে যাবে।
তপু কিছুক্ষণ দেখলো খেলাটা। বাহ্রে যখনই কাঠি দেয় তখনই আটকায়।
তপুর সামনেই দুজন অনেক টাকা পেয়ে গেল।
বাপরে এত সহজ খেলা জীবনেও কল্পনা করেনি তপু। ধরলেই টাকা পাওয়া যায়।
সাথে থাকা বন্ধু সুবুদ্ধি দিল, দোস্ত, টাকা ধর, আমিও ধরবো।
শুনেই তপুর লোভ জন্মে গেল।
ভাবলো, আমিও টাকা লাভ করবো, ৬০০ টাকা আছে। যদি কিছু লাভ করতে পারি তাহলে তো আরো সখের জিনিস কিনতে পারবো।
সাথের সবাই চলে গেছে এক-একদিকে। তপু আর সাথের আরেক বন্ধু সেখানেই নেশায় পড়ে গেল।
প্রথমে ৫০ টাকা ধরলো, সাথে সাথেই টাকাটা চলে গেল। কাঠিতে ফিতা আটকায়নি।
আবার ৫০ টাকা ধরলো। সে টাকাটাও পূর্বের মতো চলে গেল।
তপু ভাবলো, ইশ রে কি! হলো আমার ফিতার প্যাঁচ তো ঠিকঠাকই আছে! ওই লোক বারবার যেটায় আটকিয়ে টাকা লাভ করল, আমি তো সেটায়ই দিচ্ছি! আটকায় না কেন?
তপু এবার ফিতার মাথা পরিবর্তন করে কাঠি দিল, এবার টাকা ধরলো ১০০..
এবারও চলে গেল!
তপুর মনে মনে জেদ উঠে গেল, এ টাকা আমি তুলেই ছাড়বো!
তারপরে আবার ধরলো ১০০ টাকা, সেটাও চলে গেল!
রাগ আরো তীব্র হতে লাগলো। রাগে মাথা ভনভন করছে। এত আনন্দ করে মেলায় আসছে সে। আর এখন সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল!
এবার সিদ্ধান্ত নিল আর একবার ১০০ টাকা ধরবে, যদি জিতে যায় তাহলে আরো একবার ধরবে। যদি না জিততে পারে তাহলে চলে যাবে।
আবার ১০০ টাকা ধরলো। এবারও চলে গেল!
বেচারা সহজ-সরল তপু বুঝতেই পারেনি এটা ওদের একটা চালাকি ছিল।
বোকার মতো লোভে পড়ে সব টাকা হারিয়ে ফেলল সে।
রাগে-দুঃখে বুক ফেটে কান্না আসতে শুরু করলো। কি করবে কিছুই বুঝছে পারছে না। ফর্সা মুখ একদম শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।
কোনো রকম নিজেকে সামলে কান্না চেপে রেখেছে লোকলজ্জায়।
চোখে জলও এসেছিল! লজ্জা লুকাতে গিয়ে টিউবওয়েলে গিয়ে মুখ ধুয়েছে।
তারপর সে ওখান থেকে চলে এসে নৌকায় বসে আছে। কাউকে কিছু বলছে না।
যারা একসাথে এসেছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা তপুরই ছিল। আনন্দটাও তারই সবার চেয়ে বেশি ছিল।
এখন সবাই হাসিখুশি, তপু শুধু নীরব হয়ে আছে।
অনেকে প্রশ্ন করল,কি হয়েছে? উত্তরে বলল, কিছু হয়নি।
সবাই তো আর বোকা না। বললো কি হয়েছে বল, কোনো সমস্যা হলে বল, সাহায্য করবো।
তখন লজ্জায় মিথ্যা বলেছে, টাকা হারিয়ে গিয়েছে। তাই মন খারাপ।
মিথ্যা না বললে সবাই উপহাস করতো এবং বাসায় এসে বলে দিতো। বাসায় শুনলে তো মেরে বস্তা ফাটিয়ে দেবে!
আর হারানোর কথা বললে বড় জোর দু-একটা বকা দেবে। মাইর দেবে না, সে জন্য মিথ্যা বলেছে।
আসার সময় বাকি ২০০ টাকা ছিল। তা থেকে ছোটভাইয়ের জন্য একটা-দুটো খেলনা নিয়ে ফিরেছে। মেলায় আসার সময় বায়না ধরেছিল। মা ওর জন্য কিছু একটা নিতে বলছিল। না নিলে আরো বেশি বকা খাবে, তাই ওর জন্য বন্দুক আর একটা ছোট গাড়ি এবং কিছু মোয়া-মিঠেমুড়ি নিয়ে ফিরেছে।
এখন পকেটশূন্য, নৌকা ভাড়াটাও বাকিতে চলে আসে। ৭দিন পর পরিশোধ করেছিল।
মেলার দিন শেষ,
তপুর আনন্দ নিরামিষ।