মুস্তাফা মাসুদ»
শফিক সাহেব সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করে সস্ত্রীক গ্রামে সেটেলড হয়েছেন দুবছর হলো। মাঠে পৈতৃক জমাজমি কিছু আছে। তা থেকে বছরের খাওয়ার চালটা হয়ে যায়। আছে নিজের পেনশন, তাতে তিনজনের সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে। তিনজন বললাম; কারণ, পাড়াতো নিঃসন্তান বিধবা এক বোনঝি থাকে শফিক সাহেবদের সাথে। আছে কিছু সঞ্চয়পত্রও। ছেলে মেয়েরা ঢাকায় সেটেল্ড। তারাও মাঝেমধ্যে হেল্প করে− বিশেষত পালাপার্বণে তারা যখন বাড়ি আসে; সাথে এত এত পোশাকআশাক-জিনিসপত্র নিয়ে আসে, নিজেদের প্রায় সারাবছর কিছু কেনাই লাগে না।
তো, বলতে গেলে একটা সুখী সংংসার বলতে যা বোঝায় শফিক সাহেবের তা আছে। কিন্তু তার পরেও এই দুবছরে তিনি একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছেন। সারাজীবন কলম পিষেছেন। এখন এই দুটো বছর একেবারে কোনো কাজ নেই। খাওয়া, ঘুম আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত মসজিদে গিয়ে পড়া। আরও একটা কাজ তিনি অবশ্য করেন, সেটি হলো কম্পিউটারে খবরের কাগজ পড়া আর ইউটিউব দেখা− এই অভ্যেসটি তার বহুদিনের। এ কারণে কম্পিউটারে তার বেশ ভালোই দখল আছে। কিন্তু তাতেও তার মন ভরে না। গ্রামের সবুজশ্যামল প্রকৃতি আর মাঠভরা ফসলের সম্ভার তাকে উতলা করে দেয়। তখন তিনি যেন তার ঝলমলে কৈশরে ফিরে যানÑ বড়ো দু-ভাইয়ের সঙ্গে মাঠে হাল চাষ করছেন, জমিতে নিড়ানি দিচ্ছেন, ভরা আষাঢ়ে কখনো-বা কচি কচি ধানের চারা রোপন করছেন; পৌষের শুরুতে পাকা পাকা সোনালি ধান কেটে আঁটি বাঁধছেন… হঠাৎ কে যেন ডাকছে!… পঞ্চাশ/পঞ্চান্ন বছর আগের স্মৃতির ঘোর কাটতে একটু সময় লাগে শফিক সাহেবের। সম্বিত ফিরে তাকিয়ে দেখেন কলিম তাকে ডাকছেÑ ও দাদা, চ্যাচায়ে গলা ফাটায়ে ফ্যাললাম এ্যাহেবারে। তা ঘুমায়ে পড়িছিলেন নাকি?
− না রে ভাই, ঘুমাইনি। এই − একটুখানি−− চিন্তা কত্তিছিলেন, তাইতো! কাজকাম নেই তো…
− শোন্, কলিম। শুয়ে-বসে তো আর সময় কাটে না রে, ভাই। একটা কাজ করে দিবি আমাকে?
− কী কাজ, দাদা? − এক বিঘে জমি কিনে দিবি। কলিম অবাক হয়Ñ জমি! জমি দিয়ে আপনি কী করবেন! মাঠে আপনার যে জমি আছে, তাইতো রয়চে বরগা দেয়া…
− না, মাঠের জমি না। সবজি চাষ করব, এমন জমি চাই। আর তুইতো আমার সাথে আছিস, নকি? লাগলে আরও দুয়েকজন নেবো। নো চিন্তা। হ্যাঁ ভাই, এক বিঘে দিয়েই শুরু করি তারপর দেখা যাবে। জমানো যা টাকা আছে, তাতেই হয়ে যাবে। কলিম সব বুঝতে পেরেছে, এমন ভাব করে হো হো করে হেসে ওঠে। এরপর জমি খোঁজার পালা। পাওয়াও গেলো কয়েকদিনের মধ্যে। দালাল নয়, সরাসরি মালিকের সাথে কথা বলেই জমি কেনা হলো। আতার খালের পাড়েরই একটা জমি। সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত। অনতিবিলম্বে রেজিস্ট্রি হয়ে গেলো জমি। দুতিন দিনের মধ্যে ডুপ্লিকেট দলিলেরও একটা ব্যবস্থা হলো। এবার এলো জমির নামজারির প্রশ্ন। শফিক সাহেবের স্ত্রী বললেনÑ জমি দলিল হয়ে গেছে, এখন তো আর কোনো চিন্তা নেই। তোমার জমিতে এখনই তুমি সবজি চাষ শুরু করে দাও।
− না গিন্নি। জমিটা আমি কিনেছি সত্যি, কিন্তু ওটা আমার হয়নি এখনও। আগে আমার নামে নামজারি হোক, তারপর সবজি চাষ। তখন গিন্নি বলেন− শুনেছি নামজারি করতে গেলে অনেক হ্যাপা। টাকা পয়সার শ্রাদ্ধ ছাড়াও ঘোরাঘুরিও নাকি করতে হয় বিস্তর। তখন শফিক সাহেব কেবলই হাসতে থাকেন, বলেন না কিছুই। এবার শফিক-গিন্নির সন্দেহ হয়। তিনি স্বামীর হাত ধরে বলেন− কী ব্যাপার, হাসছো ক্যানো বোকার মতো? শফিক সাহেব এবারও কিছু বলেন না, আস্তে আস্তে এগিয়ে যান কম্পিউটারের দিকে। চেয়ারে বসে কম্পিউটার খোলেন− তোমার সব প্রশ্নের জবাব আছে এখানে। শোনোনি, গত ১লা অক্টোবর ২০২২ তারিখ থেকে সরকার জমির ই-নামজারি প্রথা চালু করেছে? না না, তোমার আর দোষ কী− তুমি তো পেপারই পড়ো না, টিভিতে সিরিয়াল দেখেই তোমার সময় কাটে। মিসেস শফিক এবার বেশ লজ্জা পান মনে মনে। তাই কিছু না-বলেই স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন নামজারির তামাশা দেখার জন্য।
শফিক সাহেব প্রথমে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঢোকেন। তিনি দেখতে পান− ‘অনলাইনে আবেদন করুন’ যেখানে লেখা আছে, তার নিচে লেখা আছে ‘নামজারি আবেদনের জন্য ক্লিক করুন’। সেখানে ক্লিক করলেই আবেদন ফরম চলে এলো চোখের পলকে। এরপর নির্ভুলভাবে আবেদন ফরম পূরণের পালা। শফিক সাহেব স্ত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত নথিটি আনতে বললেন। স্ত্রী দ্রুত আলমারি থেকে তা এনে দিলেন। এবার শফিক সাহেব আবেদন ফরমে তাঁর নাম, জন্মতারিখ, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর, জমির পর্চা বা খতিয়ান নম্বর, মৌজা নম্বর, দাগ নম্বর ইত্যাদি নির্ভুলভাবে লিখলেন। আবেদন ফরম পূরণ শেষ হলে এবার তা সাবমিটের পালা। তার আগে একটা জরুরি কাজ বাকি আছেÑ ২০ টাকা আবেদন ফি আর ৫০ টাকা নোটিশ ফি, এই ৭০ টাকা অনলাইনে পেমেন্ট করে নিতে হবে, তিনি তাই করলেন। বিকাশ অ্যাপ-এর মাধ্যমে টাকাটা পেমেন্ট দিয়ে তিনি আবেদনপত্রটি সাবমিট করে দিলেন। তারপর স্ত্রীর দিকে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলেন: ব্যস, আপাতত শেষ। এখন যা হবে ভূমি অফিসে। − কী হবে ভূমি অফিসে?Ñ স্ত্রীর এই প্রশ্নে শফিক সাহেব বলেন: মোট ২৮ দিনে সাধারণত একটি জমির নামজারির প্রক্রিয়া শেষ হয়। অথচ আগে মাসের পর মাস চলে যেত এই কাজে। টাকা পয়সা নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারীর কথাও শোনা গেছে আগে। যাহোক, আমার আবেদন সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর কাছে পৌঁছাবার পর আমাকে এবং জমির পূর্ববর্তী মালিককে শুনানির জন্য ডাকা হবেÑ অর্থাৎ আমার কাছে এসএমএস আসবে, যাতে এই জমি নিষ্কণ্টক কী না তা যাচাই করা যায়। তবে কেউ ইচ্ছা করলে সেই শুনানি অনলাইনেও দিতে পারে। অবশ্য, অনলাইনে শুনানি করতে চাইলে আগেই আবেদন করতে হয়। যাহোক, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমার আবেদনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে অফিস সহকারী অনলাইনে এর খতিয়ান প্রস্তুত করবেন আমার আবেদনপত্রে সন্নিবেশিত তথ্যাবলি/ডকুমেন্টসের ভিত্তিতে। খতিয়ান প্রস্তুত হলেই আমার মোবাইলে এসএমএস চলে আসবে ডিসিআর ফি জমা দেয়ার জন্য। তখন আমি সেই লাস্ট পেমেন্টটি অর্থাৎ ১,১০০/- দিব মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। অনলাইনে টাকা পরিশোধ করার পর অনলাইনে চালানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। এরপর https://mutation.land.gov.bd/ এই লিঙ্কে ঢুকে আবেদন ট্রাকিং করে খতিয়ন এবং ডিসিআর-এর প্রিন্ট কপি পাবো। অতএব, খেল খতম। আপতত মাসখানেকের অপেক্ষা। দেখলে তো, শেখ হাসিনার ডিজিটাল ম্যাজিক!
এক অনাবিল তৃপ্তির আভা খেলা করে শফিক সাহেবের চোখেমুখে।
পিআইডি ফিচার