টোল আদায় নিয়ে প্রশাসন জনগণ মুখোমুখি

বাঁশখালীর তৈলারদ্বীপ সেতু 

বাঁশখালীর তৈলারদ্বীপ সেতু। ছবি: সুপ্রভাত

উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী প্রতিনিধি »

চট্টগ্রামের বাঁশখালী-আনোয়ারা উপজেলার মধ্যবর্তী ‘তৈলারদ্বীপ সেতু’র টোল আদায়কে কেন্দ্র করে প্রশাসন ও জনগণ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। দীর্ঘ আড়াই মাস টোল আদায় বন্ধ রয়েছে।

বাঁশখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল বন্ধে মানুষের গণদাবি হওয়ায় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে গত ২০ অক্টোবর তদন্ত করা হয়েছে। আনোয়ারা উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও আমার উপস্থিতিতে লোকজনকে নিয়ে গণশুনানি হয়েছে। জনগণের দাবির বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছি।’

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন,  ‘গত ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রাম দক্ষিণের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা এক বক্তব্যে তৈলারদ্বীপ সেতুর বার্ষিক রাজস্ব আয় ১০ থেকে ১১ কোটি টাকা, বর্তমানে টোল আদায় বন্ধ, পুনরায় টোল আদায়ের জন্য প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রয়োজন উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমি ওই বিষয়ের জবাবে সভায় জানিয়েছিলাম, জনগণের টোল আদায় নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। টোল আদায় শুরু হলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’

জাতীয় পার্টির নেতা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও বাঁশখালীর সাবেক এমপি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘তৈলারদ্বীপ সেতুতে টোল আদায় বন্ধ করা বাঁশখালীবাসীর ন্যায্য দাবি। এ দাবির সঙ্গে আমিও একমত। এই টোল বন্ধে আমি উচ্চ আদালতে রিটও করেছিলাম।’

বাঁশখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা কামরুল ইসলাম হোসাইনী বলেন, ‘টোল আদায় বন্ধের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের গণশুনানিতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তৈলারদ্বীপ সেতুতে টোল আদায় বন্ধ করা জনগণের যৌক্তিক দাবি, ওই শুনানিতে আমি বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরেছিলাম।’

বাঁশখালী উপজেলার ছাত্র-জনতার সমন্বয়ক মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ‘তৈলারদ্বীপ সেত এখন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু। টোল আদায় বন্ধ হলে জনদুভোর্গ ও গাড়ি ভাড়া কমবে।’

সড়ক ও জনপথ বিভাগ দোহাজারী, চট্টগ্রাম দক্ষিণের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘সেতুর টোল আদায় বন্ধ করার প্রক্রিয়া আমার হাতে নেই। আমি সংশ্লিষ্ট দফতরে যাবতীয় বিষয় জানিয়ে দিয়েছি। দীর্ঘ আড়াইমাস টোল আদায় বন্ধ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় টোল আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি কিভাবে সুরাহা করা যায় তা চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ মাপের কমিটির সিদ্ধান্ত ব্যতিত টোল আদায় বন্ধ সম্ভব নয়।’

জনবিক্ষোভে সেতুর টোল আদায় গত ৫ আগষ্ট থেকে বন্ধ হলেও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় টোল আদায়ের নির্দেশনাকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে গণশুনানি অনুষ্ঠান করেছে। এলাকাবাসী দফায় দফায় মানববন্ধন, ৩৫ হাজার ব্যক্তির গণস্বাক্ষর নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে টোল বন্ধের দাবি করেছে। তারপরও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের টোল বন্ধে স্থায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান না করায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে নানামুখি ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) বলছে, বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া টোল আদায় বন্ধ সম্ভব নয়। অপরদিকে, বিক্ষুব্ধ জনতার সাফ জবাব, পুনরায় টোল আদায় হলে প্রতিহত করা হবে। তারা অভিযোগ করেন, এই টোল আদায় সওজ’র কিছু কর্মকর্তা ও ইজারাদারের চাঁদাবাজি ছাড়া কিছুই নয়।

ভুক্তভোগী জনসাধারণের দাবি হচ্ছে, চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদীর ওপর বাঁশখালী-আনোয়ারা উপজেলার মধ্যবর্তী সীমান্তে ২০০১ সালের ১৭ জানুয়ারী ৫১২ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হয়। প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৬ সালের ২৯ আগষ্ট এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষে গাড়ী চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করা হয়। র্দীঘ ১৮ বছর ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টোল আদায়ের প্রেক্ষিতে দেখা গেছে নির্মাণ ব্যয়ের ৩ গুণ ৯০ কোটি টাকার অধিক আয় হয়েছে। অথচ সাঙ্গু নদীর ওপর বিভিন্নস্থানে একইরকম আরও ৬টি সেতু থাকলেও ওই সেতুগুলো থেকে টোল আদায় হয় না। তৈলারদ্বীপ সেতু থেকে ঠিকই টোল আদায় হচ্ছে। জনগণের দাবি, সেতুটি যেহেতু দেশীয় টাকায় নির্মিত তাই টোল আদায় বন্ধ করার ঘোষণা দেয়া হোক।

দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে ১৮ বছরের টোল আদায়ের হিসেবে জানা গেছে, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ এক বছরে ৪১ লক্ষ ৬০ হাজার ১৫৪ টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ ৪৮ লক্ষ ৪২ হাজার ৬৬৬ টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে তানসি এসোসিয়েট ৫০ লক্ষ ১০ হাজার ৯৩২ টাকা, ২০১১-১২ অর্থ বছরে মেসার্স রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ এক কোটি ৮ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে মেসার্স আনোয়ারুল আজিম এন্ড ব্রাদার্স এক কোটি ১৩ লক্ষ ১২ হাজার ৪০০ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে মেসার্স কবির কনস্ট্রাকশন দুই কোটি ২৯ লক্ষ তিন হাজার ২০০ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মেসার্স রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ দুই কোটি ৩৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ২০১৮-২০ অর্থ বছরে মেসার্স এস.এফ আর এন্টারপ্রাইজ ১৫ কোটি ৫৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, ২০২০-২৩ অর্থ বছরে ফরহাদ ট্রেডিং ২৪ কোটি টাকা, ২০২৩-২৬ অর্থ বছরে জে.এ ট্রেডিং ৩১ কোটি ৮৭ লক্ষ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা ইজারামূল্যে বিভিন্ন মেয়াদে সেতুর ইজারা নেন।