মুহাম্মদ আইয়ুব »
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা ঔপনিবেশিক আমলের উন্নয়ন ধারা, আইন ও প্রশাসন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সক্ষমতা প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারছিনা।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের আর্থিক বছর (জুন-জুলাই) পরিবর্তন সম্পর্কিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ হচ্ছে। রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নতুন নতুন বন্দর, আরো অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। প্রায় সব কাজই দৃশ্যমান। বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ বছর আর আর্থিক বছর এক নয়। দেশের সকল হিসাব-নিকাশ, আয়-ব্যয় পরিকল্পনা আর্থিক বছর ধরেই করা হয়। বছরের শুরু ও শেষ পূর্বনির্ধারিত। তবে আর্থিক বছর পরিবর্তন করা যায়। গত কয়েক দশকে বহু দেশ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক বছর পরিবর্তন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আর্থিক বছরে কোন পরিবর্তন হয়নি। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে পাওয়া আর্থিক বছরেই অনুসরণ করা হচ্ছে যা জুলাই মাসে শুরু হয় এবং জুন মাসে শেষ হয়।
জুলাই থেকে জুন আর্থিক বছর কেন? তৎকালীন বৃটেনে আর্থিক বছর ছিল-জুলাই-জুন মাসে। তাদের সাথে মিল রেখে উপমহাদেশেও আর্থিক বছর একই রাখা হয়। হয়তো পশ্চিমা দেশগুলোর আবহাওয়া বিবেচনা করেই এই সময় ঠিক করা হয়েছিল। ব্রিটেনেও আর্থিক বছর পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে বৃটেনে আর্থিক বছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে, যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় অক্টোবর মাস থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে আর্থিক বছর জুলাই-জুন মাসে।
জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর অনুসরণ করা হয় অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, চীন, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন ও সুইডেনে। ইংরেজি মাসের বিভিন্ন তারিখেও কোন কোন দেশে অর্থ বছর শুরু হয়। যেমন ১৭ জুলাই নেপাল, ১১ সেপ্টেম্বর ইথিওপিয়া, ২১ মার্চ ইরান। এ রকম হওয়ার কারণ হতে পারে এসব দেশের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অর্থবছর ঠিক করা। যেমন- বাংলাদেশে যদি বৈশাখ- চৈত্র মাসে আর্থিক বছর ধরা হয়, তাহলে অর্থবছর ইংরেজি মাস অনুযায়ী শুরু হবে ১৪ এপ্রিল।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী আর্র্থিক বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর বা এপ্রিল-মার্চ (বৈশাখ-চৈত্র মাস মিলিয়ে করা যায়) হতে পারে। এতে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই আগের বছরের সব কাজ শেষ করা সম্ভব। বর্তমানে জুলাই-জুন মাসে আর্থিক বছর হওয়ায় জুন মাসের মধ্যে ঠিকাদারেরা বিল পেতে সারা দেশের রাস্তা-খাল-নালাসহ সকল কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় এবং জুন মাসে বৃষ্টির সময় কাজগুলো যেনতেনভাবে করে বা না করে বিলগুলো ঠিকই তুলে নেওয়া হয়। এতে জনগণের করের টাকা বৃষ্টির পানিতে চলে যায়। কাজগুলোও হয়ত মানসম্মতভাবে হয় না। এছাড়া আমাদের দেশের ঠিকাদাররাও বসে থাকে কখন জুন আসবে, বৃষ্টি আসবে তারপর কাজ শুরু করবে। কাজ শেষ হোক বা না হোক বিল ঠিকই তুলে ফেলবে।
প্রসঙ্গত, সরকারের টাকা বলে কিছু নেই। জনগণের করের টাকায় সরকার চলে। সরকারি ব্যয় উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই বৃদ্ধি সামাল দিতে করের আওতাও বাড়ছে। জনগণ কর দেয় সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সার্ভিস পেতে। সরকারও সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু জনগণের কষ্টের করের টাকা যদি পরিকল্পনার অভাবে পানিতে ভেসে যায় তা কারো কাম্য নয়।
কিছুদিন আগে জাপানের একটি নির্মাণ কোম্পানি বাংলাদেশে দুইটি ব্রিজের কাজ নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ করে সাশ্রয় হওয়া ৭০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারকে ফেরত দিয়েছে। আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। ঠিকাদার বা নির্মাণ কোম্পানিসমূহ কাজ না করে টাকা উঠানোরও অনেক নজির আছে।
অতএব, আর কালক্ষেপণ না করে আর্থিক বছর জুলাই-জুন পরিবর্তন করে আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে শুষ্ক মৌসুম হিসাব করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর আর্থিক বছর করলে জনগণের টাকা সাশ্রয় হবে। অধিকন্তু দেশের রাস্তা-খাল-নালা-বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে মানসম্মতভাবে কাজ করা যাবে। এতে দেশের উন্নয়ন দ্রত হবে এবং জনগণের টাকারও সদ্ব্যবহার হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।