নিলা চাকমা »
রাঙামাটি জেলার প্রান্তিক এলাকার বাসিন্দা কল্যানী (ছদ্ম নাম)। আর্থিক সংকটের কারণে ২০১৪ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন চট্টগ্রামে একটি পোশাক কারখানায়। চাকরির বেতনে ভাইকে পড়াচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিয়েছেন বাবা-মার ভরণ পোষণের দায়িত্বও। এরমধ্যেও কিছু টাকা ছিলো তার সঞ্চয়। সেই জমানো টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আউট সোর্সিংয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। চাকরিতে মাসিক বেতন দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও যোগদানের পাঁচ মাস পরেও কোনো বেতন পাননি তিনি।
জানা যায়, চলতি বছরে চমেক হাসপাতালে আউট সোর্সিংয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে নিয়োগের টেন্ডার পেয়েছে বি.এস.এস সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড। ফেব্রুয়ারিতে ১৯৩ জনকে নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এই নিয়োগ পাওয়া ১৯৩ জনের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চল থেকে রয়েছেন ৫ জন। যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে পুলিন চাকমা, স্বপন চাকমা এবং টিটো চাকমার একটি চক্র। নিয়োগ পেয়ে প্রায় সকলেই কাজে যোগদান করেন। জুন মাস পর্যন্ত বেশিরভাগ কর্মী বেতন পেয়েছেন। কিন্তু টানা ৪-৫ মাস সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও এখনো বেতন পাননি কল্যাণীসহ আরও তিনজন। বেতন না পেয়ে চাকরি ছেড়ে একজন পোশাক করাখানায় ও অন্যজন বাড়িতে চলে যান।
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি কল্যানী চমেক হাসপাতালে নিয়োগের সাক্ষাৎকার (ভাইবা) দিয়ে যান। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি কল্যানীকে টাকা নিয়ে চমেক হাসপাতালে দেখা করতে বলেন পুলিন চাকমা। এ সময় পরিচালকের ভবনের সামনে কল্যানী নগদ ৮০ হাজার টাকা পুলিন চাকমাকে দেয়। বাকি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এক ঘণ্টার মধ্যে দিতে বলেন। পরে নগদ অ্যাপে ১৫ হাজার টাকা এবং বিকাশে ১ লাখ ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এভাবে চক্রটির আরও দুই সদস্য অমরজিত এবং সুজনের নিকট থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়। অর্থ নেওয়ার আগে বলা হয় দুই মাসের মধ্যে তারা বেতন পাবে। কিন্ত টানা ৫ মাস কাজ করেও কোনো বেতন পাননি তারা।
ভুক্তভোগী কল্যানী বলেন, ‘আমি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। তারা আমাকে বলেন, চমেক হাসপাতালে চাকরি করবো কিনা। আমি চাকরি করার সম্মতি জানানোর পর কুলিন চাকমা আড়াই লাখ টাকা দাবি করলে অসম্মতি জানাই। কিন্ত তিনি আমার পরিবারের সদস্যকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করায়। দ্রুত বেতন পাবার কথা বললে মার্চ থেকে আমি কাজে যোগদান করি। কিন্ত সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো বেতন পাচ্ছি না। অথচ আমার সাথে সাথে নিয়োগ পাওয়া প্রায় সকলেই বেতন পেয়েছেন। এখন আামর ভাইকে পড়াশোনার খরচ এবং বাবা মাকে একটি টাকাও দিতে পারি না। নিঃস্ব হয়ে গেছি। টাকা দিয়ে চাকরি, তবু বেতন মিলে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর চারমাস কাজ করেও কোনো বেতন পাইনি। অন্যরা রোগীদের থেকে চেয়ে নিতে পারে যেটা আমি পারি না। অথচ আমার থেকে ২ লক্ষ টাকার উপরে নেওয়া হয়েছে। বেতন না পেয়ে পাঁচ মাসের চমেক হাসপাতাল ছেড়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছি।’
বিষয়টি অস্বীকার করে পুলিন চাকমা বলেন, ‘টাকা নিলেও সব টাকা টিটো চাকমাকে প্রদান করি। টেন্ডার পাওয়া কোম্পানিকে আমি চিনি না। টিটো চাকমার মাধ্যমে সব কথা হতো। কোম্পানি আর টিটো চাকমা মিলে টাকাটা ভাগ করে নিয়েছেন। যদি টাকা নাই নিতো তাহলে কি নিয়োগ দিত কোম্পানি? নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পরও ৫-৬ মাস কাজ করিয়েছেন তারা। কিন্ত কোনো বেতন দেয়নি। আর বেতন দেওয়ার দায়িত্ব তো আমার না।’
এ প্রসঙ্গে বি.এস.এস সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডের পরিচালক আবুল খায়ের বলেন, ‘আমরা নতুন টেন্ডার পেয়েছি। ১৯৩ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছি। কিন্ত কোনো অর্থ লেনদেন হয়নি। কোন আর্থিক লেনদন করলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় বলে নিয়োগপত্রে স্পষ্ট লেখা আছে। স্বপন চাকমা, পুলিন চাকমা এবং টিটো চাকমা তারা আমাদের কেউ নন। টেন্ডার পাওয়ার পর আমাদের সাথে অনেকে যোগাযোগ করেন। তারাও যোগাযোগ করে ৫ জনের নাম দিয়ে যান। আমরা তাদের লোকগুলোকে নিয়োগ দিই। পরে জানতে পারি চাকরি দেওয়ার নাম করে তারা লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইতেমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে উত্তরা থানায় সাধারণ জিডি করে করা হয়েছে। তারা কয়েক জন মিলে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। পাহাড়ের সহজ সরল মানুষকে ফুসলিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।’
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে টিটো চাকমার সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
বেতন না হওয়া নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানের সঙ্গে। কিন্তু তিনি বর্তমানে বিদেশে থাকায় কোনো মন্তব্য নেওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমা বলেন, ‘এ বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিচালক স্যার দেখেন। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তিনি বর্তমানে বিদেশে আছেন, দেশে আসলে উনার থেকে মন্তব্য নিলে ভালো হয়।’