শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
ভেজাল মসলায় বাজার সয়লাব হচ্ছে মুনাফালোভী কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। দায়িত্বশীল সংস্থার লোকবল-ব্যবস্থাপনা সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান না হওয়ায় তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। এতে লিভার ও কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্যাকেটজাত মসলা গুড়ো বাজারজাত করে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আর খোলা ও খুচরায় বিক্রি হয় ক্রাশিং মিলের মসলা। অধিকাংশ ক্রাশিং মিলের অবস্থান বাকলিয়া, বন্দরটিলা ও বায়েজিদ এলাকায়। কোনো স্টিকার বা বিএসটিআইয়ের লোগো ছাড়াই ট্রান্সপারেন্ট পলিব্যাগে বিক্রি হওয়া এসব মসলায় মিশ্রিত থাকে ভূষি ও রাসায়নিক রং। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমতি ছাড়া এসব মসলা বিক্রির নিয়ম না থাকলেও প্যাকেটজাত মসলার অধিক দামের কারণে খোলা মসলার চাহিদা অনেক বেশি।
দেখা যায়, কোম্পানি ভেদে প্যাকেটজাত শুকনো মরিচ গুড়ো ৫১০ টাকা থেকে ৫৬০ টাকা, হলুদ গুড়ো ৪৪০ থেকে ৫০০ টাকা, জিরা ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা, ধনে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। এরচেয়ে আনুমানিক ৫০ থেকে ১৮০ টাকা কম রেখে বিক্রি হয় খোলা বাজারের মসলাগুলো।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন বলেন, ‘মসলায় ভেজালের ঘটনা আজকে নতুন না। প্রতিবছর প্রশাসনের অভিযানে এসব ধরা পড়ে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শুধু মসলা নয়, সব ধরনের খাদ্যে ভেজাল করে বেশি লাভ করতে চায়। আগে খাতুনগঞ্জ এলাকায় অনেকে ছিলো। কিন্তু এসব ব্যবসায়ীরা এখন নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর না হলে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
এ নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক রানা দেব নাথ বলেন, ‘আমরা চাই শুধু মসলা নয়, সব ধরনের পণ্য প্যাকেটজাত হোক। প্যাকেটজাত হলে সেটা মনিটরিং করতে সুবিধা। আমরা বাজারে থাকা পণ্যগুলো ভোক্তাদের স্বার্থে মনিটরিং করতে পারি। কিন্তু প্যাকেটজাত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেখতে হবে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ভেজাল মসলা নিয়ে কোনো অভিযান পরিচালনা করিনি। কোরবানের সময় বেশকিছু অভিযান চালিয়েছিলাম। তখন দেখেছি, অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র ভূষি ও রাসায়নিক রং মিশ্রণ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মসলা উৎপাদন করে এবং সেগুলো বিক্রি করে। এগুলোতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোগোতো দূরের কথা, উৎপাদন ও মেয়াদোর্ত্তীণের তারিখও থাকে না।’
এ নিয়ে বিএসটিআইয়ের সিএম (সার্টিফিকেশন মার্কস) শাখার সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত সার্ভেল্যান্স অভিযান পরিচালনা করি। ব্যবসায়ীদেরও উদ্বুদ্ধ করি বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে। কিন্তু এ ধরনের কার্যক্রম তারা সিটির বিভিন্ন দিকে পরিচালনা করে। মূল সিটির বাইরে অর্থাৎ বিশেষ করে কোতোয়ালী, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ এলাকার বাইরে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা বেশ মুশকিল। ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াই আমরা অনেক অভিযানে যাই। সার্ভেল্যান্সও হয়। কিন্তু জনবল কম হওয়ায় ওভাবে মনিটর করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে বিশ্ব মান দিবসে বিএসটিআইয়ের অনুষ্ঠানে তারা জনবল সংকটের কথা তুলে ধরেছিলো। জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিলো, কোন সময় তারা যেতে পারেনি সেটা জানাতে। তখন তো তারা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট কবে যেতে পারেনি, তা জানাতে পারেনি। জনবল সংকট বাংলাদেশের সবগুলো সংস্থাতেই আছে। এসব মুখস্থ কথা না বলে যতটুকু জনবল আছে, ততটুকু দিয়ে কি কাজ করা যায়, সেটা তারা করুক। আমার জানা মতে, কোরবানের পরে মসলা নিয়ে কোনো অভিযানও হয়নি। কিন্তু সবজায়গায় খোলা মসলা পাওয়া যায়। ভোক্তাদের স্বার্থে মসলা দেখার দায়িত্ব বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরের। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে একটা-দুইটা অভিযান পরিচালনা করলেও পরে আর কোনো ফলোআপ করে না। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে যায়।’
ভেজাল মসলার কারণে মানবদেহের কি ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুর রব মাসুম বলেন, ‘ভেজাল মসলায় তারা টেস্ট ও কালার আনতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। এতে টক্সিনের পরিমাণ বেশি হলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এর মধ্যে লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। কারণ টক্সিন শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো আটকে রাখে। এ ধরনের ভেজাল মসলা দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে লিভার ও কিডনি ফেলইউর হওয়ার শংকা তৈরি হয়। আর এগুলো বাজারে আসতে না দিলে কিডনি ও লিভার রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’