নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি :
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িদের বড় একটি অংশের প্রাচীন পেশা জুমচাষ। অপেক্ষাকৃত উঁচু ও মাঝারি পাহাড় চূড়ায় বসবাসরত পাহাড়িরা বাংলা সনের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পাহাড়ে আগুন দিয়ে পোড়ানো, জুমকাটা (অপেক্ষাকৃত বড় গাছগুলো ছাঁটাই) ও নিড়ানির কাজ শেষ করে। বৈশাখে হালকা বৃষ্টি হলে জুমবীজ বপন করে। আর ফলন তোলা শুরু হয় ভাদ্র মাস থেকে।
ইতোমধ্যে অনেকে জুমের পাকাধান তুলতে শুরু করেছে। জুমচাষ শ্রমসাধ্য হলেও এ সময়টাতে জুমচাষিরা নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে থাকে। যখন জুমের ফলন ভালো হয় তাদের আর কষ্টের কথাগুলো মনে থাকে না। এক একটি জুমিয়া পরিবার জুমের পেছনে বছরের ৯-১০ মাস সময় ব্যয় করে থাকে। এভাবেই তাদের জীবন চলে।
এবার খাগড়াছড়ি জেলায় জুমের ফসল ভালো হয়নি। করোনার অভিঘাতে ক্ষতির মুখে পড়েছে জুমচাষিরা। করোনায় ফলনের ন্যায্য হিসাব মেলাতে পরছেন না দরিদ্র জুমচাষিরা।
ধান-ভুট্টা-মারফা জুমের প্রধান ফসল হলেও এর সাথে মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, বিভিন্ন ধরনের কচু, কাউন, চিনার, মরিচ, আদা, হলুদসহ নানান শাকসবজি একই সাথে উৎপাদন করা হয়।
জুমচাষিদের মতে, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জুমের ধানপাকা শুরু হলেও, জুলাই মাসের শুরু হতে জুমের নানা শাকসবজী সংগ্রহ শুরু হয়। প্রধান ফসল ধান তোলার পরও জুমে কাউন, আদা-হলুদ থেকে যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আদা-হলুদ তোলার পর জুম থেকে ফসল তোলা শেষ হয়।
জুমকৃষি ও সংস্কৃতির গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, জুমচাষ সাধারণত একই জায়গায় প্রতিবছর করা হয় না। অতীতে পাহাড়ের এক জায়গায় জুমচাষ করা হলে, অন্তত ৫-৬ বছর পর ঐ পাহাড়ে আবারও জুমচাষ করা হতো। সময়ের এই ব্যবধানের কারণে পাহাড়ের মাটি জুমচাষের উর্বরতা ফিরে পেতো। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সময়ের এই ব্যবধান কমে এসেছে।
কৃষিবিদ রেন্টিনা চাকমা জানান, জুমচাষ সম্পূর্ণ সনাতনী ও প্রকৃতিনির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতি। এ চাষে কোনো সেচের প্রয়োজন হয় না। ইদানীংকালে মাটির উর্বরতা বাড়াতে জুমচাষিরা সার, কীটনাশক প্রয়োগ করছে। যা অতীতে করা হতো না। জুমের উৎপাদিত ফসল ও নানান সবজির স্থানীয়ভাবে চাহিদা বেশি। কারণ, জুমে উৎপাদিত ফসল সমতল জায়গায় উৎপাদিত ফসলের চেয়ে সুস্বাদু।
উন্নয়নকর্মী বিনোদন ত্রিপুরা জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পাহাড়ে মাথাপিছু জায়গা-জমির পরিমাণ কমে আসছে। তদুপরি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জুমচাষ আর লাভজনক নয়। তাই দেখা যায়, জুমচাষিরা আম লেবু মাল্টা কলার চারা ইত্যাদিও রোপণ করছেন। ফসল তোলা শেষ হলে ঐ জায়গাটি তখন স্থায়ী ফলের বাগানে রূপ নেয়।
এ বছর করোনা মহামারির কারণে পরিস্থিতি ভালো নয়। জুমে পোকামাকড় হয়েছে। এ কারণে ফলনও ভালো হয়নি। জুমচাষ করলে পরিচর্যা করতে হয়। এ বছর তেমন পরিচর্যা হয়নি। করোনা পরিস্থিতির কারণে বের হতে পারিনি।
কৃষিবিভাগের হিসাব মতে এ বছর খাগড়াছড়িতে জুমচাষ হয়েছে ২ হাজার ২শ ৫০ হেক্টর পাহাড়ে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এ বছর ২,২৫০ হেক্টর জায়গায় জুমচাষ করা হচ্ছে। জুমের ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩,১৫০ মেট্রিক টন।
খাগড়াছড়ি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মর্ত্তুজ আলী জানান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জুমচাষের উপযোগী নতুন ধান উদ্ভাবনে কাজ করছে। গত দুবছর ধরে বিনা-১৯ জাতের ধান জুমচাষিদের কাছে পরীক্ষামুলকভাবে বিতরণ করা হয়। এর ফলাফল আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিবিদরা। জুমচাষের উপযোগী নতুন উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন ও চাষপদ্ধতি আরো আধুনিকায়ন করা হলে জুমনির্ভর জনগোষ্ঠী স্বনির্ভর হতে পারবে বলে অনেক কৃষিবিদ মনে করছেন।