ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্বে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়ায় ২০ একর জমির অবস্থিত এই শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠায় প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রত্যাশা ছিল, বাংলার শতাব্দী প্রাচীন ও সেরা মানের সুতার মসলিন জামদানির ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে এটি।
এর উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনের গুণমান ও বিপণন বাড়ানো, বাজারে উচ্চ চাহিদা থাকা নকশা ও নমুনা সরবরাহ করা এবং গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা। এ ছাড়া, কারিগরদের অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান, উদ্যোক্তা ও তাঁতিদের পুনর্বাসন এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নও এর লক্ষ্য ছিল।
কিন্তু, বাস্তবে এসবের কিছুই সেখানে ঘটছে না।
শিল্প নগরীটি নির্মাণ করা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) থেকে এসব বিষয়ে কোন নির্দেশিকা, পর্যবেক্ষণ বা আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। গত এক দশকে সেখানে কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি। রাস্তাগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। একমাত্র পানির পাম্পটিও সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে।
বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত না পেয়ে, ভারতীয় জামদানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পেরে এবং মূলধনের অভাবে শিল্প নগরীর উদ্যোক্তারা হয় তাদের প্লট বিক্রি করে দিচ্ছেন অথবা অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন।
২০০২ সালে বিসিক জরিপে আড়াই হাজারের বেশি তাঁতি থাকলেও, সেই সংখ্যা এখন দুই হাজারের নিচে নেমে গেছে। জামদানি তৈরির জন্য তাঁতিদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় এবং বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন হয়। সেই তুলনায় উপযুক্ত মজুরি না পেয়ে তাঁতিরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও সেই পথেই হাঁটছে। ফলে, জামদানি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত।
জামদানির তাঁতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে একজন শিক্ষানবিশ তাঁতির অন্তত ১০ বছর লাগে। এ ছাড়া, জামদানির নকশা আসে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। এসব নকশার কৌশল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে মৌখিকভাবে যায়।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জামদানি শিল্প জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ইন্টেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটির তালিকায় স্থান পায়। এ ছাড়া, সরকার পাঁচ বছর আগে জামদানিকে একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শীতলক্ষ্যার পানির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মাটি ও খনিজ জামদানি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী।
জামদানি শিল্প নগরীর উদ্যোক্তারা ২০২০ সালে প্রায় ৬০ হাজার পিস শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি পোশাক থেকে ৩০ থেকে ৩২ কোটি টাকা আয় করেন। যদিও, প্রায় ২০ বছর আগে এসব থেকে বার্ষিক উপার্জন ছিল ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার মতো।
ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের উদ্যোক্তা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ বছরে জামদানি শাড়ির চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
ঢাকার ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের আদি জামদানি কটেজের বিক্রয়কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১০ বছরে দেশে জামদানি পণ্য, বিশেষ করে শাড়ির চাহিদা চার থেকে পাঁচ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিন্তু, ভারতীয় জামদানি শাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য বিষয়টি ক্ষতিকর।’
ফ্যাশন ব্র্যান্ড কে ক্রাফটের পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘জামদানি একটি বিশেষ পণ্য। ফলে এর কাঁচামাল বিশেষ মানের হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্যমূল্যে সারা বছর ধরে মানসম্মত কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘পণ্য তৈরিতে জড়িত শিল্পীদের বিশেষ যত্ন নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। মূলধন বাড়ানো, নকশায় বৈচিত্র্য এবং কর্মীদের জীবনমানের সামগ্রিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
টিকে থাকার জন্য শিল্প নগরীর কিছু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠিত দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে পণ্য সরবরাহের চুক্তি করছে এখন।
তাঁতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের অনলাইনে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিতে হবে। জামদানি কারিগরদের বেতন বাড়তে হবে।’
জামদানি বিপণনে সরকারি সহায়তা অপর্যাপ্ত বলে অভিযোগ করেন তাঁতিরা।
বিসিক প্রতি বছর জামদানি পণ্যের তিনটি মেলার আয়োজন করে। একটি পহেলা বৈশাখের আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং দুটি ঈদুল ফিতরের আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
এ ছাড়া, ভারতে কয়েকটি মেলার আয়োজন করা হলেও, সর্বোচ্চ ২০ জন তাঁতি এসব মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
বেলাল হোসেন নামের এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘সরকারের উচিত প্রথমে জামদানির জন্য একটি মার্কেটপ্লেস তৈরি করা, যেখান থেকে আমরা সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারি। এটি আমাদের পণ্যের সুনাম বাড়াবে। জামদানি বাজারও বাড়াবে।’
নিয়ম মানতে নারাজ উদ্যোক্তারা
বিসিকের নিয়ম অনুসারে, শিল্প নগরীর উদ্যোক্তাদের তাদের নামে বরাদ্দ প্রতিটি প্লটে কমপক্ষে তিনটি তাঁত চালু রাখতে হবে। কিন্তু, এর ৪০৭টি প্লটের ৫০ শতাংশেই একটি বা দুটি তাঁত রয়েছে বলে বিসিক কর্মকর্তাদের অভিযোগ।
উদ্যোক্তারা বাকি জায়গায় ঘর তৈরি করে বাড়ি হিসেবে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা। সম্প্রতি সেখানে সফরের সময় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অবৈধভাবে প্লট বিক্রি
ব্যবসা চালিয়ে যেতে না পেরে উদ্যোক্তাদের একটি অংশ নিয়ম ভেঙে তাদের প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০০টিরও বেশি প্লটে এ ঘটনা ঘটেছে। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিসিকের নিয়ম অনুযায়ী, একজন উদ্যোক্তা বিসিককে ৭০ হাজার টাকা হস্তান্তর ফি দিয়ে একটি প্লট বিক্রি করতে পারেন।
কোনো উন্নয়ন কাজ নেই
সম্প্রতি জামদানি শিল্প নগরী পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কোনো পাকা সড়ক নেই। পুরো এলাকা জুড়ে আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তাঘাটে ড্রেনের ময়লা উপচে পড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সামান্য বৃষ্টিতেও সেখানে হাঁটু পানি জমে যায়।
এলাকান বআসন্দা লাভলী বেগম বলেন, ‘যখন বৃষ্টি হয় তখন চলাচল করা কঠিন। আমরা বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে অভিযোগ করেছি। কিন্তু, কোনো লাভ হয়নি। বছরের পর বছর ধরে চলছে এ অবস্থা।’
উদ্যোক্তারা জানান, বিসিক শিল্প নগরীর একমাত্র পানির পাম্পটি ২০১০ সাল থেকে অকেজো ছিল। সম্প্রতি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু, এখনো পানি সরবরাহের লাইন তৈরি হয়নি।
শিল্প নগরীর প্রধান কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যার বিষয়ে অবগত। তারপরও, আমি আবার তাদের সঙ্গে কথা বলব। আশা করি আমরা ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান করতে পারব।’
বিসিক চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান বলেন, ‘শিল্প নগরীর পরিকল্পনায় ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো তাঁতিদের তাদের পরিবারের সঙ্গে সেখানে বসবাস করতে দেওয়া। এ সিদ্ধান্ত শিল্প নগরীর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ভুলটি সংশোধনযোগ্য নয়। আমরা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু, পারিনি।’
সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার