সুপ্রভাত ডেস্ক »
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা এবং দ্বিতল সড়কে গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের মত নানা ইস্যুতে বিডিনিউজের সাথে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ।
এতদিন পরিবেশ রক্ষাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। এখন সিডিএ চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিলেন। বাসযোগ্য চট্টগ্রাম নগরী গড়তে কী করবেন?
যে প্রকল্পগুলো এখনও বাস্তবায়নাধীন এবং কাজ শুরু হয়নি সেগুলোকে দ্রুত গতিতে সমাধান করার চেষ্টা করব। যদি আমি এগুলোকে ফেলে রেখে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দৌড়াই তাহলে সুফল বয়ে আনবে না।
আমার প্রথম কাজ জলাবদ্ধতার যে প্রকল্প চলমান সেটি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী এটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই জলাবদ্ধতা।
কীভাবে কী করা যায় তার টেকনিক্যাল দিকগুলো আগে দেখব। দেখে যেখানে যেখানে মেয়রের প্রয়োজন, আমি উনার সঙ্গে বসে উনার সহযোগিতা নেব। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী সর্বমহলের সহযোগিতা নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করব।
এরপর আগের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলোর কাজের অগ্রগতি দেখব। প্রকল্পগুলো শেষ করার জন্য স্কেলিং করে দেব।
মানে পুরো কাজ শেষ করতে কতদিন লাগবে? যদি বলে, ছয় মাস লাগবে, তাহলে এক মাসে কতটুকু হবে, দুই মাসে বা তিন মাসে কতটুকু হবে, মাস শেষে কতটুকু কাজ হয়েছে সেটা দেখব। কয়দিন পর এসে বলবেন, কাজের মেয়াদ বাড়ানো হোক- সেটা আমি মানব না।
জলবায়ুর প্রভাব, পরিবেশ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ও ভবিষ্যতে এই নগরীর জনসংখ্যা কত হতে পারে এগুলো মাথায় রেখে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন সবার সঙ্গে বসে, পরামর্শ নিয়ে বাকি পরিকল্পনা করব।
সামনেই বর্ষা। জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন স্বয়ং মেয়র ও কাউন্সিলররা। কী করবেন?
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পরিকল্পনা যারা করেছিলেন এবং যারা কাজ করেছিলেন তারা সবাই আমার আগের। আমি আজসহ চতুর্থ দিন মাত্র অফিস করছি। আগে যারা কাজ করেছেন, সেটার ফলাফল হয়ত আমার উপর এসে পড়বে।
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ এখনো আমি দেখতে যেতে পারিনি। কাজ যতটুকু হয়েছে, খাল বা নালার কাজ যে হয়েছে সেটা পরিষ্কার আছে নাকি তাতেও ময়লা রয়ে গেছে?
খাল হয়ত আমরা করছি, কিন্তু ড্রেজিং এর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। উনাদেরকে শুধু খাল কতগুলো দিয়ে দিলেই তো হবে না। তাই মেয়র মহোদয়কে নিয়ে মাঠে নামব।
প্রয়োজনে দুই ভাই খালে নেমে দেখব ময়লা আছে কি না। তারপর খাল পরিষ্কার হলে উনাকে বুঝিয়ে দেব।
সিটি করপোরেশন ও সিডিএর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং পরস্পরকে দোষ চাপানো চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সিটি মেয়ররা এবং সিডিএর আগের চেয়ারম্যানরা সমন্বয়ের কথা বললেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি। আপনি কী করবেন?
আমরা সবাই এই চট্টগ্রামের মানুষ। আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করব না তো। শেখ হাসিনার স্বপ্নকে আমরা সবাই মিলে বাস্তবায়ন করব। তিনিও শেখ হাসিনার কর্মী, আমিও শেখ হাসিনার কর্মী। দুজনে মিলেই কাজ করব। কেউ সহযোগিতা না করলে আমি কারো সঙ্গে ঝগড়া করব না।
আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। ছোটবেলা থেকে আমি এই চট্টগ্রাম শহরেই রাজনীতি করেছি, আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। এখন যারা কাউন্সিলর আছেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ নেতাদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে। তাই উনাদের সম্পৃক্ত করতে কোনো সমস্যা হবে না।
কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে মেয়রসহ বসে করব। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অগ্রগতির জন্য কীভাবে কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করা যায় সেটাই লক্ষ্য। এর আগে পিডি এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বসে আগে আলোচনা করব। সব সময় আমি দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলব যাতে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারি।
টাইগারপাসে দুইতলা সড়ক কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন চলছে। ইতিমধ্যে সিডিএ নকশা সংশোধন করার ঘোষণা দিয়েছে। আপনি সিআরবি রক্ষায় আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। র্যাম্পের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন?
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অন্য যে র্যাম্পগুলো আছে সেগুলোর কাজ আমি শুরু করে দেব। এই র্যাম্পটি স্থগিত করা হবে। এটার জন্য ড. অনুপম সেনসহ অন্যান্যদের নিয়ে বসব।
আমি নিজেও নাগরিক সমাজের একজন। গাছ ও পাহাড় না কেটে কীভাবে আমরা কী করতে পারি সেটা আলোচনা করব।
সেখানে র্যাম্পটা না করলেও আগামী ২০ বছর পর যখন জনসংখ্যা বাড়বে তখন কি হবে সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে।
সিআরবি রক্ষার জন্য আমরা বলেছি, গাছ কাটতে পারবে না। আমার একটা লক্ষ্য আছে পুরো সিআরবিকে নিয়ে যে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটাকে ঘিরে সিডিএ থেকে প্রাণ-প্রকৃতি নির্ভর একটি প্রকল্প নিতে চাই।
সেখানে শহীদদের কবরগুলো সংরক্ষণ করা হবে। সব বৃক্ষ ও প্রাণ রক্ষা করে কীভাবে আরো সুন্দর করা যায় সেই পরিকল্পনা করতে চাই পরিবেশবিদদের পরামর্শ নিয়ে।
আন্দোলনের সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছার নামে আমরা জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করেছিলাম। সেই নামে প্রকল্পের মাধ্যমে সিআরবি রক্ষার আন্দোলনকারীদের দাবি বাস্তবায়ন করতে চাই।
নগরীতে ফ্লাইওভার এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প গ্রহণের সময় এসব প্রকল্পের সমালোচনা ছিল। এগুলো আদৌ প্রয়োজন কিনা এবং এসব প্রকল্প করা হলে পরে মেট্রোরেল কীভাবে করা হবে সেই প্রশ্নও উঠেছিল। এখন মেট্রো রেল করতে সরকারের আগ্রহের বিষয়টি আলোচনায় আছে। আগে এত বড় বাজেটের প্রকল্পগুলো কতটা যথার্থ ছিল?
কথা যা উঠেছিল তা বাস্তব। অতীতে হয়ত আগপিছ না ভেবে প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে গাড়ির মালিকরা। গরিব মানুষ কোথায় উঠবে? পাশাপাশি যদি মেট্রো রেল থাকত তাহলে সবাই ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু এখন করতে গেলে আগের অবকাঠামো ভাঙতে হবে। ভাঙা কি সম্ভব? বিকল্প কী করা যায় সেজন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে মেট্রো রেল দরকার।
আরেকটা কথা বলি, চট্টগ্রাম শহরকে ঘিরে কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না এখন আর। বন্দর যদি বে টার্মিনাল ও মহেশখালীতে চলে যায় তাহলে চট্টগ্রাম শহরকে ঘিরে এখনকার প্রাণচাঞ্চল্য নাও থাকতে পারে। কারণ, শহরের আশেপাশে যদি আর্থিক কর্মকাণ্ড না থাকে তাহলে সে শহরে মানুষ থাকে না।
এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন করতে হবে এবং সেই জোন থেকে মানুষ যাতে সহজে চলাচল করতে পারে সেই যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যবস্থাও করতে হবে। শুধু গাড়ি চলাচলের অবকাঠামো করলেই হবে না।
সিডিএ অতীতে আবাসিক এলাকা করার কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছিল। আপনিও কি প্লট বরাদ্দ করবেন?
আমার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে প্লট নয়, ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকতে চাই। আড়াই কাঠা বা তিন কাঠার প্লট দেব, সেখানে ভালো করে একটা ঘর হবে না। আবার আমরা যে প্ল্যান দেব সেটা অনুসরণ করতে বলব। সেটা খুবই কঠিন।
ভালো মত একটা জমি বেছে নিয়ে যদি বহুতল ভবন করতে পারি, আশেপাশে বাগান করে দেব। এজন্য কাউকে জমি ছাড়তেও হবে না, নিজের খরচও করতে হবে না।
ভবন যাতে টেকসই হয় তা যাচাইয়ে কোনো ল্যাবরেটরি এখানে নেই, ল্যাবরেটরি করব। একজন মানুষ আজীবনের সাধনায় একটা ঘর করবেন, কদিন পর তা ভেঙে পড়বে, তা হবে না।
কয়েকটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এবং ব্যয় বাড়ায় সেই বর্ধিত ব্যয় সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিতে হয়েছে সিডিএকে। সেই টাকা কীভাবে শোধ করবেন?
বিভিন্ন প্রকল্পে সিডিএ ২৪০০ কোটি টাকা দেনাগ্রস্ত। পত্রিকায় দেখলাম। আমি এটা নিয়ে ওদের (সিডিএ কর্মকর্তাদের) সঙ্গে বসব, এই দেনা কেন আমার হল?
সিডিএ একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখন থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সব চলে। উন্নয়নের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা সরকার থেকে প্রকল্পের অধীনে দেওয়া হয়। এখানে এক খাতের টাকা আরেক খাতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কাজগুলো ঠিকমত হচ্ছে কিনা সেটা দেখব। তারপর করণীয় ঠিক করব।
নগরী নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
চট্টগ্রামকে বাণিজ্যের জন্য গতিশীল একটি নগরী হিসেবে গড়তে চাই। যদি সেটা না পারি তাহলে বাণিজ্যিক রাজধানী অভিধা হবে শুধু মুখে মুখে। এজন্য কিছু অবকাঠামো প্রয়োজন। শুধু প্রবীণ নয়, নবীনদের মতামতকেও আমি গুরুত্ব দেব। সবার সহযোগিতা ও দোয়া চাই। সবার পরামর্শ নিয়ে আমি কাজ করব। চেয়ারে বসেছি বলে সর্বেসর্বা আমি নই।
প্রয়োজনে আপনার পরামর্শও আমি নেব। আপনারা বাড়ির পাশে কী সমস্যা সেটা আপনি যতটুকু বলতে পারবেন, আমি ততটা বলতে পারব না।
প্রধানমন্ত্রী যে বরাদ্দ দেবেন কড়ায় গণ্ডায় সেই কাজ আদায় করে নেব। তারপর আমি নতুন প্রকল্প নেব। কোনো অসংগতি দেখলেই নাগরিকরা যেন সরাসরি আমাকে বলেন, আমি ব্যবস্থা নেব।