মাছুম আহমেদ »
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলা থেকে শেক্সপীয়রের নাটক, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলির কাব্য, মেকলের প্রবন্ধ পড়ে ইংরেজদের মহত্বের আসনে বসিয়েছিলেন। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে জন ব্রাইটের বক্তৃতা শুনে তাতে খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতা, উদারতা আর ঔদার্যের বার্তা। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে কবিগুরুর মন্তব্য: “মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ চরিত্রে। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম”। তিনি লিখেছেন, “তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এতো গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে।”
কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের গোধূলি বেলায় অর্থাৎ ৮০ বছর বয়সের পরিপক্ক প্রজ্ঞার আলোয় উপলব্ধি করলেন মানবজাতির সভ্যতার সংকট। পরিণত বেলায় সেই রবীন্দ্রনাথ দেখলেন ইংরেজদের কদর্য রূপ। যে ইউরোপের জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলোয় সমস্ত মানব জাতি আলোকিত হবে বলে ভাবা হয়েছিল, সেই ইউরোপই বিশ^জুড়ে ডেকে এনেছে ধ্বংসের তা-ব। তাদের সা¤্রাজ্যবাদী লালসার ছায়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গোটা ভারতবর্ষ। তাই ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে কবিগুরুর মন্তব্য:, “ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয় ম-লে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্য নয়, আগুন লাগাবার জন্যে”। তিনি আক্ষেপ করে লিখলেন, “প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে”। মনোবেদনায় ভারক্রান্ত বিশ^কবি আরো লিখলেন: “সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হল, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধহয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনোদেশেই ঘটেনি”।
তবে, সংকট নিরসনে আশার প্রদীপটি রবীঠাকুর নিভিয়ে দেননি। তিনি আশায় বুক বেঁধেছেন, পূর্ব দিগন্ত থেকেই আসবে মুক্তির আলো। তাই ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে কবিগুরুর প্রত্যাশা: “আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে”।
কবিগুরুর প্রার্থিত সেই মুক্তির কা-ারির আত্মপ্রকাশ ঘটলো! পর্ববঙ্গে উদিত হলো স্বাধীনতার রবি, শেখ মুজিব। ক্রমে ক্রমে হয়ে তিনি ওঠলেন ‘জনতার মুজিব’। নির্যাতিত, শোষিত বাঙালির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠলেন। ইংরেজ তাড়িয়ে শোষণহীন পাকিস্তান গড়ার স্বপ্নে বিভোড় হলেন।
ইংরেজ শাসন ছিলো সাত সাগর আরে তেরো নদীর ওপার থেকে। তারা শোষণের সম্পদে নিজেদের শিল্প বিল্পব ঘটিয়েছে, বাঙালি থেকেছে খেয়ে-না খেয়ে। শাসনে জনতার অংশগ্রহণ ছিলো সুদূর পরাহত! শাসকেরা ছিলো জনবিচ্ছিন। আশা ছিলো পাকিস্তান হলে স্বশাসন ফিরবে। কিন্তু সেই আশায়ও গুড়ে বালি! শোষণে ইংরেজদের চেয়েও হিং¯্র হলো পাকিস্তানি সরকার। হলো দুই পাকিস্তান: শাসনের ও শোষণের। পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের স্বপ্নসাধ থেকে বিচ্ছিন্নই থাকলো। শাসনে তাদের অংশ মিলল না। শাসকেরা জনবিচ্ছিন্নই থাকলো! তাদের মনভোলানো কথা জনতা বিশ^াস করলো না। সরকারি সংবাদের ওপরও জনতার আস্থার সংকট তীব্র হলো। সরকারি ভাষ্যের অতিরঞ্জন জনতাকে সঠিক তথ্য থেকেও সরিয়ে দিলো বহু দূরে ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকের কথা। ১৯৫২ সালের ১ অক্টোবর। পিকিং শহরে চীনের স্বাধীনতা দিবসের ‘শান্তি শোভাযাত্রা’য় জনগণের অভিবাদন গ্রহণ করলেন তৎকালীন চীনের ৬০ কোটি মানুষের নেতা মাও সে তুং। অতিথি সারিতে থেকে পিস কনফারেন্সের পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সেই শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করলেন তরুণ জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও। লাখো মানুষের ঢল নামলো সেই শোভাযাত্রায়। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীদের মধ্যে কেউ বলল ৫০ লক্ষ, কারো দাবি ৪০ লক্ষ আবার কেউ বলল এক কোটি মানুষ সমবেত হয়েছে শোভাযাত্রায়। বঙ্গবন্ধু বললেন ১৫ লক্ষ হবে। অন্যরা তাঁর ওপর ক্ষেপেই গেলেন। পরে অবশ্য সবাই মিলে ২৫ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছে বলে ধরে নিলেন।
পরেরদিন চীনের সরকারি পত্রিকায় ছাপা হলো ‘৫ লক্ষ লোকের শোভাযাত্রা’। বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করলেন, “কোথায় আমরা বলি ২৫ লক্ষ! আর সরকারি কাগজ লেখে পাঁচ লক্ষ। আশ্চর্য হলাম। মিছাই কি এদেশের জনসাধারণ সরকারকে ভালোবাসে?”
তিনি আরো মন্তব্য করলেন, “আমাদের দেশের অভ্যাস, সরকারি কাগজে যদি এক লক্ষ লেখা হয় তবে আমরা ধরে নিব ২৫ হাজার। কারণ, তার বেশি তো হবেই না।” [আমার দেখা নয়া চীন, পৃ. ৫৬]
৩২ বছর বয়সী শেখ মুজিব অন্যত্র আরো মন্তব্য করলেন: “আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিলো, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নের কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এই দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন”। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৪]
তরুণ মুজিব সঠিকভাবে জনতার মনোভাব পাঠ করতে পারলেন। তিনি হয়ে ওঠলেন সাধারণ মানুষের মুখপাত্র। আন্দোলন সংগ্রামে আস্থা রাখলেন জনগণের ওপর। জনতাও এর আশাতীত প্রতিফলন ঘটালো। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে জনতা তাদের ওপর রাখা আস্থার অকৃত্রিম প্রতিদান দিলো। জনতার মানসপটে স্বাধীনতা ও মুক্তির বীজ সফলভাবে রোপণ করলেন জনতার মুজিব। হয়ে ওঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। জনগণ ও বঙ্গবন্ধুর পরস্পরের প্রতি আস্থার বন্ধন পোক্ত হলো।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ শুরু করেছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ সম্বোধন করে। জনতাকে তিনি পরিবারের সদস্য মনে করতেন। নিজের সন্তানের চেয়ে জনগণ তাঁর কাছে বেশি প্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর নাতিদীর্ঘ জীবনের পরতে পরতে জনসাধারণের প্রতি তাঁর মমত্ব আর ভালোবাসার নিদর্শন মেলে। যেমন, স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁর অনুভূতি, “ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবু তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।” [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৬৪]
৭ই মার্চের সমাবেশে সেদিন রেসকোর্সের ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতা আর রাজনৈতিক-সমাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মী। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শুরুতেই জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন”। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু জনতাকে ঘটনার পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেননি। তিনি সাধারণ মানুষকে অসচেতনও মনে করেননি। বাস্তবতায় জনগণকে তিনি অবিচ্ছিন্নই গণ্য করেছেন। এতে করে জনগণ তাদের নেতৃত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে পরেছেন। নেতৃত্বের প্রতি আস্তাভাজন হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যখন উচ্চারণ করলেন ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” জনতা এ ঘোষণাকে নিছক আশ^াস নয়, বরং একটি প্রতিশ্রুতি আর প্রতিজ্ঞা বিবেচনা করে সেই প্রতিজ্ঞায় নিজেরাও অবিচল হয়েছেন। সেই পথ বেয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। জনগণের স্বাধীনতা।
নেতৃত্ব যদি সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয় সাধারণ মানুষ সেই নেতৃত্বকে আপনত্বে জড়িয়ে রাখে। জনমানুষের অবস্থা, অবস্থান, মনোভাব আর জীবনাচারের প্রতি নেতৃত্ব যদি নির্মোহ, নিশ্চুপ থাকে তাহলে কার্যত নেতা আর নেতা থাকে না। সে তখন জনবিচ্ছিন হয়ে ক্ষমতার আবরণে বন্দি হয়ে পড়ে। জনতার সঠিক খবর সে আর পায় না। এমন নেতার পক্ষে মানুষের মনোভাব অনুধাবন দুরূহ। তবে, জনগণ মোটেও অচেতন নন, তারা ঠিকই এমন নেতার কথা ও কাজে জননেতার অনুপস্থিতি স্পষ্ট উপলব্দি করতে পারেন।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-কষ্ট যদি সরকার অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, সরকারের কথায় যখন জনগণের প্রকৃত চিত্রের বিপরীত তথ্য পরিবেশিত হয় তখন কার্যত তারা সরকার তথা শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এভাবে একটি অংশগ্রহণহীন ব্যবস্থায় জনতার স্বাধীন চেতনা মলিন হয়ে ওঠে। শুরু হয় পরস্পরের প্রতি আস্থার সংকট। আশার কথা হলো বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি জনসাধারণের আস্থা অটুট রয়েছে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ^াস, যদিও সরকারের কারো কারো মন্তব্য জনগণের মনোভাবের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায় না বলে প্রতীয়মান হয়।
ইংরেজ তাড়িয়ে এবং পাকিস্তানকে পরাজিত করে নেতৃত্বের সঙ্গে জনগণের আস্থার যেই মজবুত ভিত নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ প্রার্থিত স্বাধীনতার কা-ারি এবং বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেটি কতটা ক্ষয়ে গেছে বর্তমান নেতৃত্বকে তা নির্ণয় করে সেই ভিত পুনঃনির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় মহান স্বাধীনতা দিবসে বীর শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রব্ধাবনত হওয়ার প্রকৃত তাৎপর্য হারাতে পারে।
♦ লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।