সাধন সরকার :
পূজা ঘনিয়ে আসছে। আর মাথায় একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। গত দু’বছরের মতো এ বছরও এমনটা হচ্ছে! ফোনটা বাজছে। আমি নিশ্চিত, ফোনটি আমার ছোট বোন-ই করেছে। ও সাধারণত আমাকে ফোন করে না। আমিই মূলত ওকে ফোন করি। কিন্তু পূজার আগে এটিই শুধু ব্যতিক্রম হয়। ওর আগ বাড়িয়ে ফোন করার বায়নাটা আমি বুঝি। মায়ের ফোন থেকে ফোন করে আবারও ওই একই বায়না, ‘দাদা, টাকাটা জোগাড় করেছ ? স্মার্টফোনটা এবার কিনে দেবে তো ?’ সান্ত¡না দিয়ে বললাম, ‘এবার অবশ্যই দেবো, তুই চিন্তা করিস না।’ গত দু’বছর ধরে জমিয়ে রাখা আবদার এবারের পূজায় পূরণ না করলে কী হয়! তাইতো এবার টিউশনির বেতন দুই মাস নেইনি, জমিয়ে রেখেছি। বড় ভাই হলে যে কত আবদার পূরণ করতে হয়! মাঝে মাঝে যখন বাড়ি যেতাম তখন বোনটি ওর আবদারের কথা মনে করিয়ে দিত। পড়াশোনা ও প্রয়োজনীয় কাজে স্মার্টফোন না থাকার শূন্যতা অনুভব করে ও। ওকে বললাম, ‘এবার আর ভুল হবে না।’ বুক ফুলিয়ে জবাব দিয়েছিলাম! একথা আমার বোনটি বিশ^াস করলেও আমার মা বিশ^াস করতে চাইছিল না! কারণ মা জানে আমার হাতের অবস্থা। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এ অবস্থা! কিন্তু এবার আমার দৃঢ় আশ^াস মাকেও আশান্বিত করে তুলেছে। সংশয় থাকলেও মায়ের চোখে-মুখে বিশ^াসের ছাপ দেখে স্মার্টফোন কেনার ইচ্ছাটা আরও দৃঢ় হয়। একটি মাত্র ছোট বোন। যখন ছুটিতে বাড়ি যায়, বোনটি সবকিছু গুছিয়ে রাখে। আবার যখন ফিরে আসি ওই আবার সব গুছিয়ে দেয়। ওর খুশি যেন সবার খুশি। যাহোক, এবার আর মিথ্যা আশ^াস নয়। ওর স্বপ্ন পূরণ করবই।
এমন সব ভাবনায় দিন ভালোই কাটছিল। এবার একসাথে তিন মাসের টিউশনির টাকাটা পেলেই হলো। হঠাৎ এক দুঃসংবাদে আকাশ থেকে পড়লাম! ছাত্রীর মা-বাবা বিদেশে চিকিৎসা করাতে গিয়েছে। ফিরতে মাসখানেক লাগবে। আমার টিউশনির টাকাটা তাই রেখে যেতে তাদের মনে নেই। মনটা খারাপ করে হতবিহ্বল অবস্থায় টিউশনি থেকে বাসায় ফিরলাম। হায় রে ললাটলিখন! জমিয়ে না রেখে প্রতি মাসে টাকাটা যদি নিজের কাছে রাখতাম, তারপরও তো কিছু টাকা নিজের কাছে থাকত! ভাগ্য বুঝি এভাবেই অভাগার সঙ্গী হয়! মনকে সান্ত¡না দিলাম এই ভেবে যে, ছাত্রীর মা-বাবা বিদেশ থেকে আসলেই তো একসময় টাকাটা পাওয়া যাবে। যাহোক, বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে ঘর ভাড়ার টাকাটা এ মাসে না দিয়ে এর সাথে আরও কিছু টাকা বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়ে স্মার্টফোনটা কিনে ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সারপ্রাইজ দিব বলে বাড়িতে আসার কথা কাউকে আর বলিনি! সারা দিনের ক্লান্তি, পূজার আনন্দ ও সর্বোপরি স্মার্টফোন কেনার আমেজে মনটা একাকার। কখন যে ট্রেনের ঝকঝক শব্দে ঘুমিয়ে পড়েছি টের-ই পায়নি। নতুন প্যাকেটসহ ফোনটা ব্যাগের মধ্যেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি ব্যাগটা গায়েব! ভাগ্য আবারও বিড়ম্বনা করল আমার সাথে। আমি ওর স্বপ্ন পূরণ করতে এবারও পারলাম না! জীবন বুঝি একেই বলে! অসহায় মন আর অবশ হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পৌঁছে দেখি বোনটি স্মার্টফোনে কী যেন ঘাঁটাঘাঁটি করছে। অবাক হয়ে বললাম, ‘এটা কার!’ ও জানাল স্থানীয় এক মেলায় গত সপ্তাহে ‘কুইজ প্রতিযোগিতায়’ প্রথম হয়ে সে এটা উপহার পেয়েছে। আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে বলেনি! আমার সমস্ত ক্লান্তি ও মন খারাপ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।