জঙ্গল ছলিমপুর
শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
পাহাড় কেটে অবৈধ দখলে যাওয়া চট্টগ্রামের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকা। প্রায় ১৪টি সমাজ মিলে গড়ে ওঠা এ এলাকার পাশেই রয়েছে আলীনগর। এ এলাকাগুলো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বায়েজিদ বোস্তামী ও চট্টগ্রাম পুলিশ রেঞ্জের সীতাকুণ্ড থানায় অবস্থিত। এলাকাটি প্রায় ২০০২ সাল থেকে অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেলেও বসতি ঘন হতে থাকে ২০১৮ সালের দিকে।
দরিদ্র মানুষের সঙ্গে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন জায়গার দাগি আসামিসহ রোহিঙ্গা কিছু পরিবার। এ নিয়ে দীর্ঘদিনের আড়মোড়া ভেঙে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন মাঠে নামলেও কয়েক দফায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার পর কিছুটা পিছিয়ে এসেছে প্রশাসন। ফলে দখল ছাড়েনি কোনো অবৈধ দখলদার।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৩০ আগস্ট (মঙ্গলবার) সর্বশেষ জঙ্গল ছলিমপুরে অবৈধ বসবাসকারীদের সরে যেতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে মাইকিং করা হয়। মাইকিংয়ে উল্লেখ করা হয়, কেউ জায়গা খালি না করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্য এর আগে সেখানে শুধু একটি পথ চালু রেখে বিকল্প সকল পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাতায়াতের একটি পথেই বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। বসানো হয়েছিল পুলিশ ও র্যাবের পৃথক দুটি চৌকি। তবে দিন গড়াতে গড়াতে র্যাবের চৌকি ওঠে যায়। পুলিশের চৌকি রয়ে গেলেও তা চলে এসেছে জঙ্গল ছলিমপুর ১ নম্বর গেট এলাকায়। এছাড়া উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে অবৈধ দখলদারদের যাতায়াত দুর্গম করতে বন্ধ করে দেওয়া হয় সিএনজি অটোরিকশার চলাচল। কিন্তু পরবর্তীতে আবার চালু হয়েছে।
জঙ্গল ছলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকাটি সরেজমিনে দেখা যায়, এ এলাকা থাকা অপরাধীদের চিহ্নিত সংরক্ষিত এলাকা খ্যাত আলীনগরে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে সাময়িকভাবে বিপাকে পড়েছেন এ এলাকার বাসিন্দারা। ওখানে ভাড়াবাসায় থাকা কিছু পরিবার ঘটি-বাটি গুছিয়ে চলে গেলেও দখলদাররা তাদের দখল আঁকড়ে ছিলেন। তারা এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার পক্ষে না। আবার অনেকে পুনরায় বসতি গড়া শুরু করেছেন। তাদের দাবি, যারা যাচ্ছেন তারা স্বল্পমূল্যে সেখানে ভাড়া থাকতো। বারবার উচ্ছেদ অভিযান হওয়ায় তারা বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন। কিন্তু গত কয়েকমাসে জঙ্গল ছলিমপুরে আর কোনো অভিযান হয়নি। তাই আবার পুরানো লোকেরা ফিরে আসছে।
এ নিয়ে কথা হলে ছিন্নমূলের বরইতলা এলাকার দোকানি মো. ফারুক বলেন, ‘আমাদের সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে এখানে কিছু জায়গা নিয়েছি। ২০০৬ সাল থেকে এখানে আছি। কত কষ্ট করে এখানে ঘর বাঁধলাম, হাঁটা-চলার রাস্তা করলাম। এতোদিন কেউ আসেনি। এখন হঠাৎ চলে যেতে বললে কি যাওয়া সম্ভব। আমাদের এখানে ভূমিমন্ত্রী এসে বলে গেছেন, কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না। সবার পুনর্বাসন নিশ্চিত করে এখানে সরকারি বিভিন্ন অফিস ও আরও কিছু কাজ করা হবে। কিন্তু সরকারি লোকেরা দুই-তিনদিন পরপর আমাদের উচ্ছেদ করায় ও আল্টিমেটাম দেওয়ায় ভাড়াবাসায় থাকা বেশ কিছু লোক চলে গিয়েছিল। তারা এখন আবার চলে আসছে।’
এরমধ্যে চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান আলীনগর এলাকার বেশ কিছু স্থানে সার্ভে কাজে ড্রোন উড়াতে বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানান। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি সুপ্রভাতের প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আলীনগর এলাকার বাসিন্দারা নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে, তা ইতোমধ্যে সকলেই জেনেছে। কিন্তু আমরা ড্রোন দিয়ে পুরো এলাকাটি সার্ভে গিয়ে দেখি, ওরা টেকনিক্যালি বেশ সাউন্ড (দক্ষ)। ওখানকার প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকায় আমরা ড্রোন উড়াতে পারছি না। ওরা জ্যামার দিয়ে রাখায় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’
সরকারের পরিকল্পনা জানা ও আল্টিমেটামের পরও কেন অবৈধ দখল ছাড়ছে না তা জানতে কথা হয় জঙ্গল ছলিমপুরের সক্রিয় একটি সমিতির (ছিন্নমূল সংগ্রাম পরিষদ) সভাপতি মো. গফুর প্রকাশ গফুর মেম্বারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে তাদের উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে। এখানে যারা আছে, তারা ভূমিহীন অসহায় মানুষ। তারা অল্পমূল্যে এখানে জায়গা নিয়ে (দখলস্বত্বে) বসবাস শুরু করেছে। এখন তাদের উচ্ছেদের কথা বলাটা কতটুকু মানবিক তা আপনারাই ভেবে দেখুন। আমি তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি সকলের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার। কিন্তু ছলিমপুরের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এখানে রাজনীতি করে এখানকার মানুষদের ক্ষেপিয়ে তুলেছেন।’
এ নিয়ে ছলিমপুরের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সালাউদ্দীন আজীজ বলেন, ‘আমি মানুষ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য কিছু করি না। এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। এটা সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগ। ডিসি (জেলা প্রশাসক) সাহেবের তত্ত্বাবধানে পুরো কাজটা হচ্ছে। উনি আমাদের যা করতে বলেন আমরা তা করি।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রামের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক এবিএম ফখরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি তো দায়িত্ব নিয়েছি কিছুদিন হলো। এরমধ্যে আমি অবশ্য এই জঙ্গল ছলিমপুর এলাকা নিয়ে জেনেছি। অবৈধ দখলদারদের কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। আমি জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শনে যাবো। উচ্ছেদ অভিযানও কিছুদিনের মধ্যে করা হবে। এখানে সরকার যে মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেবে, সেটাই বাস্তবায়িত হবে।’