সুপ্রভাত ডেস্ক »
বাংলাদেশে সফররত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও আগামী জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রসমূহে সম্পৃক্ততা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) ঢাকায় চীনের দূতাবাসে এক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সফররত চীনের মন্ত্রী এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, এই সফরে আমাদের সম্পর্ক আবার উন্নত হবে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) অসামান্য অবদানের জন্য আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ।’
মন্ত্রী জিয়ানচাও বলেন, আজ চীন ও বাংলাদেশ আরও ও শক্তিশালী অংশীদারিত্ব ও বন্ধুত্বের জন্য নতুন ভিত্তি তৈরি করছে, কারণ উভয় দেশ দ্রুতই উন্নতি করছে। একই সঙ্গে উভয় সরকারই জনগণের জন্য আধুনিকীকরণ যাত্রায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ঐতিহাসিক গভীরতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়ে বলেন, প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সবসময়ই চীনের অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়, যা দুই নেতার দিকনির্দেশনায় ক্রমাগত অগ্রগতি অর্জন করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময় দুই দেশের জনগণের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। এই বন্ধুত্বের শুরুটা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
রাজধানীর রেনেসাঁ হোটেলে ‘লুকিং টুয়ার্ডস দ্য ফিউচার অব চায়না-বাংলাদেশ রিলেশনস: এ কনভারসেশন উইথ দ্য সিপিসি ডেলিগেশন: শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে ঢাকাস্থ চীনের দূতাবাস। খবর ইউএনবির।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ও মিডিয়া কমিউনিটির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর আলোচনায় অংশ নেন এবং অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন এমন বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, এই অনুষ্ঠান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উদযাপনের চেয়েও বেশি কিছু; গভীর সংযোগ গড়ে তোলা এবং পারস্পরিক বৃদ্ধির পথগুলো অন্বেষণ করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তিনি বলেন, ‘চীন ও বাংলাদেশ সৌহার্দ্যের একটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালিত হচ্ছে।’
চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নের অবস্থা আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা এবং আমাদের জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার ফল। এই সংলাপ আমাদের অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল হিসাবে কাজ করে।’
উদ্বোধনী বক্তব্যে লিউ জিয়ানচাও বাংলাদেশ সফর নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানে আসার আগে থেকেই আমি এই সফর নিয়ে সত্যিই রোমাঞ্চিত ছিলাম। শুধু তাই নয় যে আমি কখনো বাংলাদেশে আসিনি, বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমি এই মহান দেশটির অর্থনৈতিক বিস্ময়ের কথা শুনে আসছি। গত দুই-তিন দিন ধরে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, চীনের চুক্তিবদ্ধ বা সমর্থিত পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর প্রকল্প পরিদর্শন করেছি।’
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদসহ বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, চীন-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব ও বন্ধুত্ব অত্যন্ত দৃঢ় রয়েছে। আগামী বছর আমরা ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি, যা আমাদের দুই দেশের মধ্যে চমৎকার সম্পর্কের অর্ধ-শতাব্দী।’
তিনি আরও বলেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে উভয় দেশ ধারাবাহিকভাবে একে অপরকে সম্মান, বিশ্বাস ও সমর্থন দিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে সমতা, পারস্পরিক সুবিধা ও শ্রদ্ধা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। চীনের স্বপ্ন এবং সোনার বাংলা একে অপরের সঙ্গে একাত্ম এবং একে অপরের সাফল্যকে কাজে লাগাতে পারে।’
তিনি ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করেন। সেসময় এই সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত হয়েছিল। তিনি গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রেসিডেন্ট শি এবং প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মধ্যে বৈঠকের কথাও তুলে ধরেন। সেসময় বৈঠকে তারা কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার, উচ্চমানের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রচার এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের বিনিময় এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন।
লিউ জিয়ানচাও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার বাস্তব সুফল তুলে ধরেন। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলসহ ১৪টি বড় অবকাঠামো প্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে বা দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো আমাদের দুই দেশের জনগণের জন্য প্রকৃত সুবিধা প্রদান করেছে এবং আমাদের ভবিষ্যত সহযোগিতার জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে।’
তিনি ভিশন-২০৪১ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চীনের প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করে অবকাঠামো, ডিজিটাল অর্থনীতি, ক্লিন এনার্জি, জলবায়ু প্রতিক্রিয়া এবং শিল্প উন্নয়নে ব্যাপক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে চীনের কূটনৈতিক নীতির রূপরেখা তুলে ধরেন মন্ত্রী।
লিউ জিয়ানচাও ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘অন্য দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লেনদেন করার ক্ষেত্রে আমরা তিনটি প্রধান নীতি সমুন্নত রাখি। প্রথমত, আমরা কখনই মতাদর্শগত সীমা নির্ধারণ করি না এবং সে কারণেই সারা বিশ্বে আমাদের বন্ধু রয়েছে। দ্বিতীয়ত, অন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তারা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক। তৃতীয়ত, আমরা মতপার্থক্য দূর করা, একে অপরকে সম্মান করা এবং একে অপরের কাছ থেকে শেখার সময় সাধারণ ভিত্তি খোঁজার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তিনি উল্লেখ করেন, চীন পারস্পরিক বোঝাপড়া, বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাদের চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ এমপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘চীন প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিপিসির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে এবং এটিই বিশ্বের একমাত্র রাজনৈতিক দল যার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ সমঝোতা স্মারক সই করেছে।’
কসমস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের (ইউএনবি) প্রধান সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন সিল্ক রুট, সামুদ্রিক এবং স্থলপথ, আজকের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে – তিনটি মহাদেশকে সংযুক্ত করে এমন একটি বাণিজ্য রুটের জন্য বেইজিংয়ের দারুণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা একবিংশ শতাব্দীর জন্য মার্শাল প্ল্যান হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে একজন তরুণ রাজনীতিবিদ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চীন সফর আমাদের মনে অবিস্মরণীয়ভাবে গেঁথে আছে।’
এনায়েতউল্লাহ খান দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। ‘২০১৬ সাল থেকে আমরা উভয় পক্ষকে প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে দেখেছি, বিশেষ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অংশ হিসাবে দুটি চীনা সাবমেরিন অন্তর্ভুক্তি, তারপরে চীনের সহায়তায় নির্মিত দেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি বানৌজা শেখ হাসিনা উদ্বোধন করা হয়েছে। ২০০৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০০ কোটি ডলার। মহামারির কারণে কিছুটা থমকে গেলেও বছরের পর বছর তা দ্রুত বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে মাত্র ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং আমদানি করেছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। আশা করা হচ্ছে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সফলভাবে সইয়ের ফলে চীনে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বাড়বে।’
তিনি মরিশাস এবং কম্বোডিয়ার ইতিবাচক উদাহরণ উল্লেখ করেন। যাদের বেইজিংয়ের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ এফটিএ সইয়ের পরে চীনে রপ্তানি দ্বিগুণ অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে অনুরূপ সমঝোতার চুক্তির আশা প্রকাশ করেছেন।
সংলাপে সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি শমী কায়সার উপস্থিত ছিলেন। এছড়া দর্শকের আসনে উপস্থিত ছিলেন কসমস গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইউএনবির নির্বাহী সম্পাদক নাহার খান এবং কসমস গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ জামিল খান।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বহুমুখী প্রকৃতি এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য উভয় দেশের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
চীনা দূতাবাস আয়োজিদ সংলাপে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।