সাধন সরকার »
যেকোনো চাকরির পরীক্ষায় আবেদন প্রক্রিয়ার শুরুতেই আসে আবেদন ‘ফি’র কথা। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সব ধরনের চাকরি, বিশেষ করে সরকারি চাকরি হলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও লোভনীয়! একথা সত্যি যে, ছাত্রজীবনে প্রায় সকল শিক্ষার্থীকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে পড়ালেখা শেষ করতে হয়। তারপর বেকারত্বের তকমা মাথায় নিয়ে হন্যে হয়ে চাকরির খোঁজে ঘুরতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন চাকরির ‘ফি’ মানেই বেকার চাকরি প্রার্থীর জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে বেকার চাকরি প্রার্থীকে মোটা অঙ্কের ‘ফি’ দিতে হয়। প্রায় সব প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির আবেদন ‘ফি’ প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। আবার কোনো কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রথম শ্রেণির চাকরিতে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘ফি’ নিয়ে থাকে। এই মোটা অঙ্কের ‘ফি’ লক্ষ লক্ষ বেকার চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত ? তবে এক্ষেত্রে কিছু দিনের জন্য হলেও বেকার চাকরি প্রার্থীদের আশার আলো দেখিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের শেষের দিকে ব্যাংকগুলোতে সব ধরনের চাকরির পরীক্ষার আবেদনে কোনো ‘ফি’ না নিতে নির্দেশনা জারি করে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছিল। ‘ব্যাংকে আবেদন করতে টাকা লাগবে না’- এই ভেবে শিক্ষিত তরুণ বেকাররা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল! কিন্তু শিক্ষিত বেকারদের জিম্মি করে পকেট খসাতে কে না চায়! ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে আবারও ব্যাংকগুলোতে আবেদন করতে ‘ফি’ (২০০ টাকা) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানে কর্মী লাগবে, তাই নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকেই খরচ বহন করার কথা। বাংলাদেশে এমনিতেই বেকারের সংখ্যা বেশি। কিন্তু শূন্য পদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে অনেক গুণ বেশি। এই সুযোগ নেন চাকরিদাতারা। বিভিন্ন পদে লক্ষ লক্ষ প্রার্থী আবেদন করলেও শেষমেষ চাকরি হয় খুব অল্পসংখ্যক চাকরি প্রার্থীর। কিন্তু আবেদনের শুরুতে সব চাকরি প্রার্থীকে মোটা অঙ্কের ‘ফি’ পরিশোধ করতে হয়। চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে নিয়োগ পরীক্ষার ব্যয় বাবদ টাকা নেওয়া কতটা যৌক্তিক ? নিয়োগ পরীক্ষার খরচ কেন বেকার চাকরি প্রার্থীদের বহন করতে হবে ?
একাডেমিক পড়ালেখা শেষে এমনিতেই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপে বেকার চাকরি প্রার্থীরা অত্যন্ত কষ্টকরভাবে দিন পার করে থাকে। শিক্ষিত বেকারেরা যখন চাকরির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করার চেষ্টা করেন তখন রাষ্ট্রেরও উচিত তাদের জন্য এগিয়ে আসা। এটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করি। প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার শিক্ষিত বেকার চাকরি প্রার্থীর দিকে চেয়ে থাকে, কখন সন্তান চাকরি পেয়ে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে। এ সময় সদ্য পড়ালেখা শেষ করা বেকারকে কত কষ্ট ও চাপের মধ্যে থাকতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউই জানে না। আর ঠিক এ মুহূর্তে চাকরির জন্য একটার পর একটা আবেদনের টাকা যোগাড় যেন ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’।
আবার অনেক সময় চাকরির আবেদন ‘ফি’ দিয়েও পাওয়া যায় না পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ! তখন আর দুঃখের অন্ত থাকে না। উন্নত দেশে বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার বেকার ভাতা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে বেকার ভাতা না হোক, বেকার চাকরি প্রার্থীরা যাতে অন্তত বিনা ‘ফি’তে পরীক্ষা দিতে পারে এ ব্যবস্থাটুকু করা উচিত। অবিলম্বে চাকরির ‘ফি’র নামে এভাবে বেকারদের ওপর শোষণ বন্ধ হোক। দেখা যায় যে, সরকারি প্রায় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে। তাই সামান্য নিয়োগ পরীক্ষার ব্যয় বহন করা নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু একজন বেকার চাকরি প্রার্থীর জন্য সামান্য ‘ফি’ মানে অনেক কিছু।
অতিসম্প্রতি ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষে’র (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে আবেদন ‘ফি’ সহনীয় করার নির্দেশ দিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। শিক্ষক হতে আগ্রহী বেকারদের ওপর যেন কোনো চাপ না পড়ে সেদিকে দৃষ্টি দিতে ‘এনটিআরসিএ’র কর্মকর্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগে আবেদন ‘ফি’ কমলে এটা হবে সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ। কেননা ‘এনটিআরসিএ’র ‘যত খুশি তত আবেদনে’ নিয়োগ প্রত্যাশী নিবন্ধনধারীদের প্রতি রীতিমতো অবিচার করা হচ্ছে। এমনিতে চাকরির বাজারে সংকট, তদুপরি করোনকালে শিক্ষাকালও দীর্ঘতর হয়েছে। করোনার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। একজন শিক্ষিত তরুণ এই পরিস্থিতিতে কীভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে। তার পরিবারও করোনায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সম্প্রসারণ করছে প্রতি বছর। বেকার তরুণদের জন্য ‘বেকার ভাতা’ চালু করলে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় শক্তিশালী হবে। এটি তরুণদের মধ্যে কিছুটা আশা জাগাবে। কপর্দকহীন তরুণ সহজেই হতাশার শিকার হয়, ধীরে ধীরে তার উদ্যম, স্বপ্ন হারিয়ে যেতে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশে তরুণদের জন্য বেকার ভাতার প্রচলন আছে। এটি ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে দেখা বাঞ্ছনীয়। এই ভাতা একজন তরুণকে হতাশা ও হীনমন্যতা থেকে মুক্তি দেবে। আমাদের দেশের অনেক তরুণ কর্মসংস্থানের অভাবে বেপথু হয়ে যাচ্ছে। একজন তরুণের ন্যূনতম সুযোগÑসুবিধা চাহিদা পেতে তার অর্থের প্রয়োজন। এই চাহিদাই তাকে নানাভাবে বিড়ম্বিত করে। মানুষ হিসেবে তার অবনমন ঘটে।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কাজে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও কালক্ষেপণের কারণে ব্যাপক অর্থের অপচয় হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সাথে ও পরিকল্পনামাফিক কাজ করা গেলে অর্থের অপচয় বন্ধ হবে। অর্থের অপচয় বন্ধ করা গেলে সেসব অর্থ নিয়োগ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা সম্ভব হবে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সরকার কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষিত তরুণদের দেশ গড়ার কাজে গড়ে তুলছে। এই তরুণেরাই তো একদিন দেশের হাল ধরবে। আর তাদেরকে সামান্য চাকরির পরীক্ষার ‘ফি’ থেকে মুক্তি দেওয়া যাবে না ? শিক্ষিত বেকারেরা এদেশের সম্পদ। তবে কেন তাদের ওপর চাকরির পরীক্ষার আবেদন ‘ফি’ নামের অত্যাচারের স্টিম রোলার চলতে থাকবে ? লাখ লাখ বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে সব ধরনের চাকরিতে আবেদন ‘ফি’ পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স