শাহ রিয়াজ, চবি:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি ও দেশের সর্ববৃহৎ ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন আজ। এর মধ্য দিয়ে ৫৩ পেরিয়ে ৫৪ তে পা রাখলো প্রাচ্যের রাণী খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে পাহাড়ি ও সমতল ভূমি মিলিয়ে ১৭৫৩.৮৮ একর ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের সর্ববৃহৎ এই ক্যাম্পাস।
মাত্র ৮ জন শিক্ষক, একটি অনুষদে চারটি বিভাগের (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি) ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বর্তমানে ৪৮টি বিভাগ, ৯টি অনুষদ আর ৬টি ইনস্টিটিউট ও ২৩৫৫৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি ডিগ্রি অর্জনে অধ্যয়ন করছে এসব শিক্ষার্থী। যাদের পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন ৯২০ জন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে মোট ১৩টি হল। এর মধ্যে ৮টি ছাত্রদের আর ৫টি ছাত্রীদের। এছাড়া নগরের বাদশা মিয়া রোডে রয়েছে চারুকলা ইনস্টিটিউটের জন্য একটি হোস্টেল। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগারের অবস্থানটিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন প্রফেসর ড. আজিজুল রহমান মল্লিক। বর্তমানে ১৮তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট অবদান। তৎকালীন পাকিস্তানের শোষণের কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন একজন শিক্ষক, ১১ জন শিক্ষার্থীসহ চবি’র ১৫ ব্যক্তি।
এ ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে কাটা, পাহাড়, ঝুলন্ত সেতু, চালন্তা গিরিপথ, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের পেছনের ঝর্ণা, হতাশার মোড়, টেলিটক পাহাড়, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি।
এই পাহাড়ি ক্যাম্পাসে মাঝেমধ্যেই দেখা মেলে বিভিন্ন জীবজন্তুর। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মায়া হরিণ, বুনো শূকর, সজারু, বানর এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও পাখি। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যার নিজস্ব জাদুঘর রয়েছে। এই ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু শিক্ষার্থীদেরকেই বিমোহিত করে না বরং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদেরও এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান বাহন হচ্ছে শাটল ট্রেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে স্থানটি দখল করে নেয় শাটল ট্রেন। প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে যাতায়ত করে। তাই শিক্ষার্থীদের নানান স্মৃতি মিশে আছে এই শাটল ট্রেন ঘিরে। শাটল ট্রেনের বগির দেয়াল চাপড়ে গাওয়া গান, প্রিয় ক্যাম্পাস, কাটা পাহাড়ের রাস্তা, ঝুপড়ি, ঝুলন্ত ব্রিজের নানা স্মৃতিগুলো আজও হাতড়ে বেড়ায় সাবেক শিক্ষার্থীদের।
চবির বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী শাহজাদা আল হাবিব বলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য দশজন শিক্ষার্থীর মতো আমিও তার চুয়ান্নতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অবর্ণনীয় আনন্দ অনুভব করি, সামনের দিনগুলোতে আরো ভালো কিছুর আশায় বুক বাঁধি। পাহাড়ের নিগূঢ় নির্জনতা, ঝর্ণার চিরচঞ্চল মুখরতা, বৃক্ষের নির্ঝঞ্ঝাট নিজস্বতা ও পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে সদা মুখরিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিটি সচেতন শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দিয়ে অনবরত শোনায় বাধা বিপত্তি মাড়িয়ে এগিয়ে চলার রণসংগীত।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়ে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, মাঝপথে আটকে রয়েছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা, দুশ্চিন্তায় ভর করেছে সেশনজট। অনাহূত এ মহামারির কারণে এসব বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সময়োপযোগী ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দশদিক বিবেচনা করে সবচেয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত, সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারাটাই হলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার বলেন, “আমাদের দেশে প্রথম দিকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। তারও অনেক পরে দেশের বুদ্ধিজীবীরা এবং বিদ্যোৎসাহীরা মনে করলেন যে চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ বোধ থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের এ দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।”
তিনি আরো বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গবেষণা কাজ বৃদ্ধি করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে। যেন আমরা বলতে পারি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সবার কল্যাণে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছি। আপনাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্ন পূরণে বদ্ধপরিকর।”
এ মুহূর্তের সংবাদ