মশিউর রহমান সেলিম »
সময়টা ২৭ জানুয়ারি বুধবার, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ। চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমিদ খানের নেতৃত্বে মোগল বাহিনীর হাতে আরাকান ম্রাউক-উ রাজ্যের বাহিনী পরাজিত হয়।১ যার ফলে নাফ নদী পর্যন্ত বাংলার সীমানা আবার পুনরুদ্ধার হয়। ম্রাউক-উ রাজ্যের শাসন আমল যাকে দুঃশাসন আর চরম অত্যাচারের কারণে এ অঞ্চলকে মগের মুল্লুক নামে অভিহিত করা হতো। ফেনী নদী থেকে সমগ্র আরাকান পর্যন্ত এ রাজ্যটি বিস্তৃত ছিল।
বঙ্গের সুলতানদের হটিয়ে মধ্যযুগে প্রায় শত বছর চট্টগ্রামে মগ রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। এ বিজয়ের পর থেকে আর কখনো বাংলার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক আওতার বাইরে যায়নি চট্টগ্রাম। মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি, স্বাধীন বাংলাদেশ যখনই যার শাসন ছিল না কেনো এই ভূখন্ডে, চট্টগ্রাম সবসময়ই ছিল বাংলার সাথে, বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে।
ম্যাপে ডটেড লাইন দিয়ে ম্রাউক-উ রাজ্য চিহ্নিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বাণিজ্যের কারণে যুগে যুগে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আরাকানিদের শাসনামলে চট্টগ্রামে বলা যায় এক ধরনের অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। স্থানীয় অধিবাসীদের দাস হিসেবে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া, দস্যুতা, লুণ্ঠন এসব নানাবিধ ব্যাপার নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। কবি আলাওলও দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে পরে নিজগুণে আরাকানের রাজসভায় জায়গা করে নিয়েছিলেন।
নানা অরাজকতায় আরাকানি বা মগদের সহায়তা করত পর্তুগিজ বা ফিরিঙ্গিরা। এছাড়া ওলন্দাজ যা তৎকালীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে অভিহিত ছিল, তাদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল মগদের। ইতিহাসবিদরা পর্তুগিজ ও মগদের নৃশংসতার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন “আরাকানের মগ এবং ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা উভয়ই প্রতিনিয়ত বাংলা (ঢাকা হইতে চট্টগ্রাম অঞ্চল) লুণ্ঠন করত। তারা যেসকল হিন্দু ও মুসলমানদের আটক করতে পারত, তাদের হাতের তালুতে ছিদ্র করে গর্তের মধ্য দিয়ে পাতলা বেতের ফিতা ঢুকিয়ে বাঁধত এবং তাদের জাহাজের ডেকের নীচে একসাথে আটকে রাখত। প্রতিদিন সকালে তারা উপর থেকে বন্দীদের জন্য কিছু কাঁচা চাল ছুড়ে দিত, যেমনটি পাখিকে খাবার ছুড়ে দেয়া হয়। তাদের দাক্ষিণাত্যের বন্দরে ডাচ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করা হত। কখনও কখনও তারা তাদের বন্দীদেরকে উচ্চ মূল্যে বিক্রির জন্য তমলুক এবং বালেশ্বরে নিয়ে আসত। শুধুমাত্র ফিরিঙ্গিরা তাদের বন্দীদের বিক্রি করত, কিন্তু মগরা বন্দীদের আরাকানে কৃষি ও অন্যান্য পেশায় বা গৃহকর্মী ও উপপত্নী হিসাবে নিয়োগ করত”২। ইতিহাসবিদরা যদিও আরাকানিদের এই শাসনামল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আরাকানিরা ফিরিঙ্গিদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তাদের শক্তিশালী নৌ বাহিনী ছিল, তাদের উৎখাত করা খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না।
কবি আলাওল আরাকান রাজের শক্তি-প্রতীক নৌবহরের বর্ণনা তার কাব্যগ্রন্থ সিকান্দরনামায় (যা পূর্ণাঙ্গভাবে ১৬৭৩ সালে প্রকাশিত হয়) বর্ণনা করেছেন:
অসংখ্যাত নৌকাপাঁতি নানা জাতি নানা ভাতি
সুচিত্র বিচিত্র বাহএ।
জরশি-পাট-নেত লাঠিত চামর যূত
সমুদ্র পূর্ণিত নৌকামএ।৩
১৬১৭ এবং ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে দুইটি মোগল অভিযান ব্যর্থ হয়।
১৬৫৭ সালে মোগল সিংহাসন নিয়ে বাদশাহ শাহজাহানের চারপুত্রের মধ্যে সংঘটিত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে তার অপর ভাইয়েরা পরাজিত হন।
আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের একজন হলেন শাহজাদা সুজা। শাহজাদা সুজা ১৬৪০ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবেদার ছিলেন।
ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহজাদা সুজার লক্ষ্য ছিল নোয়াখালী থেকে জাহাজে করে সমুদ্র পথে মক্কা অথবা ইস্তাম্বুলে চলে যাবেন। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। এদিকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের বাহিনী প্রতিনিয়ত খোঁজ করছে শাহজাদা সুজার।
আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই শাহজাদা সুজা পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্যে বিপুল সংখ্যক ধনরত্ন (প্রায় ২৩ টন ওজনের)৪ নিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যান। ১৬৬০ সালের আগস্ট মাসে এককালের পরাক্রমশালী বাঙলার সুবেদার শাহজাদা সুজার ঠাঁই হলো আরাকান রাজ্যে।
কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহজাদা সুজাকে খুন করে আরাকান রাজা। শাহজাদার পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত এবং ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ। মোগল শাহজাদার এই বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লি বাদশাহ তথা সুজার ভাই আওরঙ্গজেব আলমগীরের কাছে। মোগল সম্রাট তার ভাই শাহ সুজা এর সন্তানাদি এবং ধনরত্ন ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে পরপর দুইজন দূতকে আরাকান রাজদরবারে পাঠান। আরাকানিরা প্রথম দূতকে বন্দি করে দাস হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। দ্বিতীয় দূতকে আরাকানের রাজদরবার গ্রহণ করে কিন্তু ইতিমধ্যে সমস্ত সন্তানাদিকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের সম্পদ হাতছাড়া হয়েছে, তাই কোন সদুত্তর মেলেনি।৫
নিজ ভাই হলেও হয়তোবা ক্ষমতার প্রশ্নে কখনোই সুজার প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন না বাদশাহ আওরঙ্গজেব। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী কারো হাতে ভাইয়ের খুন!
আরাকান রাজের হাতে নিজ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে তাই নিজ মামা ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবেদার করে পাঠান দিল্লি বাদশাহ আওরঙ্গজেব।
যুদ্ধ এড়ানো যাবেনা মনে করে আরাকানিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানিরা পর্তুগিজদের সহায়তায় উল্টো ঢাকা আক্রমণ করে বসে এবং ১৬০ টির মতো নৌযান ধ্বংস করে। মোগল সম্রাটের নির্দেশে শায়েস্তা খান যুদ্ধের পরিকল্পনায় নেমে পড়েন।৬ তিনি ৩০০ যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে নৌ সেনাপতি ইবনে হোসেইন এর হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। এর সাথে শায়েস্তা খান ওলন্দাজ এবং ফিরিঙ্গিদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং ফিরিঙ্গিদের সাথে আরাকানিদের বিবাদের সুবিধা নেন।
১৬৬৫ সালের শীতকাল। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গঠন করলেন মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের এই মিশনে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে যোগ দিলেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁর সুযোগ্য পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ।
মোগলরা ওলন্দাজ কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপ দখল করে। বাংলার নৌপথ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন মুর এর নেতৃত্বে ৪০টি জাহাজ মোগল নৌ বহরের সাথে যুক্ত হলে নৌযুদ্ধ অন্য মাত্রা লাভ করে।৭ ইতিমধ্যে শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমিদ খানের নেতৃত্বে ৬৫০০ সংখ্যক মোগল বাহিনী ফেনী নদী পেরিয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মোগলদের জয়লাভের পূর্বে চট্টগ্রামকে তখন বলা হত পাহাড় এবং গাছের জঙ্গল। ঐতিহাসিকরা উপমা দিয়ে লিখেছেন বন এত ঘন ছিল যে পিঁপড়ে চলাচলের পথ ছিল না।৮ মোগল বাহিনীর জন্য ঢাকা থেকে বিপুল সংখ্যক কুড়াল সরবরাহ করা হয়েছিল যা দিয়ে তারা বন পরিষ্কার করে চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। ইতিহাসবিদরা মোগলদের এই তৈরি করা রাস্তা বর্তমান ঢাকা চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের সূত্রপাত বলে অভিহিত করেন।৯
দ্বিমুখী আক্রমণে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারির ২৭ তারিখে তিন দিন অবরুদ্ধ থেকে প্রায় বিনা বাধায় এ অঞ্চলের আরাকানিদের কেন্দ্র চাটগছার কিল্লা বা আন্দরকিল্লার পতন হয়।১০ শায়েস্তা খান এর কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে শক্তিশালী আরাকানিদের বিরুদ্ধে মোগলদের এই অসম্ভব জয় সম্ভব হয়।
আলমগীরনামায় লিপিবদ্ধ তথ্য অনুসারে অনুমিত হয় ভূতপূর্ব ম্রাউক-উ রাজা সিরিসূধম্মারাজা এর পুত্র এই মোগল বাহিনীর সাথে ছিলেন এবং মোগলদের অভিপ্রায় ছিল আরাকান দখলের পর তাঁকে রাজা হিসাবে অধিষ্ট করা।১১ কিন্তু অপ্রতুল রসদ ও বর্ষা সমাগমের কারণে তারা নাফ নদীর তীর পর্যন্ত তাদের অগ্রযাত্রা সীমিত করে।১২ মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের পর বিলুপ্ত হয় দাসপ্রথা এবং পর্তুগিজদের দাপট কমে যায়।
বুজুর্গ উমিদ খান আন্দরকিল্লা পতনের পর চট্টগ্রামের নামকরণ ইসলামাবাদ করেন এবং পরবর্তী বছরে কিল্লার উপরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যেটি বর্তমানে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের প্রবেশদ্বারের উপরে দুইটি প্রস্তর খন্ডে ফারসি ভাষায় কিছু লিখা আছে, দ্বিতীয় লেখাটির অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘হে জ্ঞানী! তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি।’
বাংলার এই অঞ্চল পুনর্দখলের জন্য রাখাইনরা এর পরে অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। পরবর্তীতে মোগলরা চট্টগ্রামে বহু স্থাপনা, মসজিদ, মন্দির নির্মাণ করে। রহমতগঞ্জ, হামজারবাগ, ঘাট ফরহাদবেগ, আসকার দীঘি, বাগমনিরাম, মোগলটুলী, পাঠানটুলী, বাগ-ই-হামজাহ মসজিদ, মিসকিন শাহ মসজিদ, কদম মুবারক মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামি মসজিদ, ওয়ালী খান মসজিদ সহ অনেক স্থাপনা চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে মোগলদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। মূলত ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এর বিস্তৃতি দেখা যায়। এগুলি চট্টগ্রামকে অনেক ঐতিহ্যবাহী করে তুলেছে। আমরা যেন এই কীর্তিগুলি সংরক্ষণ করি যাতে তা ইতিহাস মনে রাখতে সাহায্য করবে।
মোগলদের এই বিজয় না হলে হয়তো এখন রোহিঙ্গাদের মতো ফেনী নদীর তীরে আমাদেরও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
তথ্যসূত্র :
১. ড. মুহম্মদ আব্দুল করিম, বাংলাদেশের ইতিহাস. মগ বিতাড়ন ও চট্টগ্রাম জয়. পৃ ২৬৯-২৭০।
২. Sarkar, Jadunath, [First published 1948]. The History of Bengal. Vol. II, p378-379.
৩. আহমেদ শরীফ সম্পাদিত আলাওল সিকান্দারনামা পৃ ৩২-৩৩।
৪. NA VOC 1236, fol. 127-134 Letter from Gerrit van Voorburg to Batavia, dated Arakan 21 January 1661.
৫. Arakan and Bengal : the rise and decline of the Mrauk U kingdom (Burma) from the fifteenth to the seventeeth century AD, Galen, S.E.A. van, p192-193.
৬. Arakan and Bengal : the rise and decline of the Mrauk U kingdom (Burma) from the fifteenth to the seventeeth century AD, Galen, S.E.A. van, p194.
৭. Sarkar, Jadunath, ed. (1973) [First published 1948]. The History of Bengal. Vol. II: Muslim Period, 1200–1757. Patna: Academica Asiatica. p. 379. OCLC 924890. “It was Shāista Khan’s task to put an end to this terror [the Arakan pirates] … The Bengal flotilla (nawwāra) had been wofully depleted … Shāista Khan’s energy and persistence overcame every obstacle. A new navy was created, manned and equipped in a little over a year … In a short time 300 vessels were … ready in war-trim … The island of Sondip … [was] captured … (November 1665.) A still more important gain was the seduction of the Feringis of Chātgāon from the side of the Arakanese … A feud had just then broken out between the Magh ruler of Chātgāon and the local Portuguese … Shāista Khan gave their chief captain a bounty … and their other leaders were all enlisted in the Mughal service.”
৮. Nathan, Bahāristān, trans. Borah, text, fol. 272b; trans., 2: 632.
৯. চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি, চট্টগ্রামের ইতিহাস পৃ : ৫৮।
১০. চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি, চট্টগ্রামের ইতিহাস পৃ : ৬১ ।
১১. Leider, Le royaume d’Arakan, p. 311.
১২. Muhammad Kazim, ‘Ālamgīrnāma, pp. 953–56.