হুমায়ুন ফরীদি : জন্মদিনে স্মরণ
সুপ্রভাত ডেস্ক :
কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। তিনি আজ (২৯ মে) ৬৯ বছর ছুঁতেন; যদি ৯ বছর আগে হুট করে চলে না যেতেন। ১৯৫২ সালের এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন ঢাকার নারিন্দায়। আমৃত্যু কাজ করেছেন অভিনয়শিল্পের প্রায় প্রতিটি মঞ্চে। পেয়েছেন সর্বোচ্চ সফলতা। শেষাংশে এই কিংবদন্তির সঙ্গে অন্য এক সখ্যতা গড়ে ওঠে সংগীতশিল্পী প্রীতম আহমেদের। সম্পর্কে হয়ে ওঠেন পিতা-পুত্র। থেকেছেন একই বাসায়, গল্পে গল্পে কাটিয়েছেন অসংখ্য বিনিদ্র রাত। জন্মদিনে তারই কিছু অংশ স্মৃতি থেকে শেয়ার করলেন প্রীতম আহমেদ-
বাবা শব্দটির প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তিনি শুনেছিলেন ছোটবেলায় বাবার আদর পাইনি আমি, তাই নিজে থেকেই সন্তানের মতো আমাকে বাবা সম্বোধন করতেন।
কোনও অনুষ্ঠানে দেশের বাইরে গেলে ঠিক ঐ দেশের সাথে সময় মিলিয়ে দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার খাওয়ার সময় কল করে জানতে চাইতেন, ‘ঠিক-ঠাক মতো খেয়েছিস তো!’ একবার অনেকদিন পর আমেরিকা থেকে ঢাকায় ফিরলাম। উনি বলেছিলেন ঢাকায় নেমেই যেন কল দেই, এয়ারপোর্টে গাড়ি থাকবে। উনি অনেক রাত করে ঘুমাতেন, যেহেতু অনেক সকালে ফ্লাইট ল্যান্ড করলো আমি আর তাকে ঘুম থেকে না উঠিয়ে সোজা হোটেলে উঠলাম। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ উনার ফোন, ‘তুই কই বাবা?’ আমি বললাম, ‘এই তো আমার রুমে।’ বললেন, ‘কই? আমি তো তোর রুমের সামনে।’ আমি একটু অবাক হয়ে হোটেলের রুম খুলে তাকিয়ে দেখি বাইরে কেউ নেই! আমি বললাম, ‘আপনি কোন রুমের সামনে?’ উনি বললেন, ‘আমার বাড়িতে তোর যে রুম সেই রুমের সামনে।’ এবার ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি তো আমার হোটেলের রুমে।’ উনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমি রাতেরবেলা তুই সকালের নাস্তা কী খাবি সেটা ঠিক করে ঘুমালাম, আর তুই হোটেলে উঠলি? আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি, এখনই বাসায় আসবি। যদি না আসিস আমাকে আর কোনোদিন বাবা ডাকবি না।’ উনি গাড়ি পাঠালেন, আমি বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওনার ফ্ল্যাটে ঠিক ওনার মুখোমুখি রুমটা দেখিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে এটা তোর ঘর। কিছু লাগলে শাহিনকে (বাবার সাহায্যকারী) বলবি।’
রাতের পর রাত আমরা নানা রকম গল্প করে কাটিয়েছি। জীবনের কতো অজানা জটিল বিষয় উনি সহজ করে বুঝতে শিখিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না।
ওনার ৬০তম জন্মদিনের প্রস্তাব নিয়ে পরিচালক আশরাফুল আলম রিপন একদিন আমার হাতিরপুলের বাসায় এলেন। আড্ডায় আরও এলেন ছড়াকার আহসান কবির ও অভিনেতা পাভেল ভাই। রিপন ভাই বললেন, ‘ফরীদি ভাইয়ের ৬০তম জন্মদিন বড় করে পালন করতে চাই, কিন্তু উনি এসবে কোনোভাবেই রাজি হবে না, আমরা বলতে গেলে প্রথমেই যদি না করে দেয় আর রাজি করানো যাবে না। তোমার প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা আছে, তাই উনাকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার।’
আমি সাথে সাথে কল দিলাম, খুব গুছিয়ে উনাকে প্রস্তাব দিলাম। বাবা সরাসরি মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘ঘোষণা করে জন্মদিন পালন করার মতো বড় কিছু হইনাই!’ আমি বললাম, ‘আপনি বারণ করলেও আমরা করবো।’ উনি বললেন, ‘তুই কর, আমি অনুষ্ঠানে যাবো না।’ আমি বললাম, ‘আমরা আপনার ছবি বড় করে একে মঞ্চে রেখে অনুষ্ঠান করবো।’ উনি হাহা করে হেসে সম্মতি জানালেন।
আমেরিকায় পড়ালেখার কারণে সেই অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পারিনি কিন্তু আজও দেশের পক্ষ থেকে ঐ মানুষটাকে দেয়া আনুষ্ঠানিক সম্মান ওই একটাই। রিপন ভাইসহ যারা সেটার আয়োজনে ছিলেন একমাত্র তারাই হুমায়ূন ফরীদির প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা প্রদর্শন করেছিলেন সেই আয়োজনের মাধ্যমে। এটি হয়েছিল ২০১১ সালের ২৯ মে রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে। তার পরের বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে- নীরবে।
আমরা সবাই মানুষ হিসেবে জন্ম নিই ঠিকই, কিন্তু সবাই মানুষ হয়ে উঠতে পারি না। ওনার সাথে যাদের মেশার সুযোগ হয়েছে শুধু তারাই জানেন, উনি কতটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। তিনি একজন অসম্ভব ভালো অভিভাবক ছিলেন- শুধু আমার নয়, শিল্পাঙ্গনে অসংখ্য শিল্পীর জীবন ও ক্যারিয়ারে অনেক বড় অবদান রয়েছে এই মানুষটার।
শুভ জন্মদিন বাবা। যেখানে আছেন, জানি ভালোই আছেন।