নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন
রাজিব শর্মা
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে এক সময় সিংহভাগ বাণিজ্য হতো নৌপথে। মানুষের চলাচলের প্রধান মাধ্যম নৌযোগাযোগ। তবে সময়ের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় নৌবাণিজ্যের পাশাপাশি নৌযোগাযোগব্যবস্থাও হ্রাস পেয়েছে। তবে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা বহুবিধ হলেও নগরীর চাক্তাই খালের ওপর নির্ভরশীল বোয়ালখালী, পটিয়া ও আনোয়ারার উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকা। তাছাড়া কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরের মানুষ ও পণ্য এখনো প্রায়ই নৌপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কর্ণফুলীর মোহনায় অভয়মিত্র ঘাট ও ১৫ নম্বর জেটি ঘাট থাকলেও চাক্তাই খালের মুখে কোনো ধরনের ঘাটই নেই। কোন ঘাট না থাকাতেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাজারো সাধারণ মানুষ ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের।
পটিয়ার মালিয়ারা থেকে আসা মাহমুদ হোসেন সওদাগর বলেন, ‘প্রায় দুবছর ধরে আমাদের এখানে কোনো ঘাট নেই। আমরা যেখানে নৌকা পাই, সেখান থেকেই উঠি।’
বোয়ালখালী থেকে আসা ইউসুফ নামের এক মাঝি বলেন, ‘আমরা দিনে ২০ থেকে ২৫টি ট্রলার করে বোয়ালখালীতে যাত্রী পারাপার করি। কিন্তু আমাদের কোন ঘাট না থাকাতে বিভিন্ন সময়ে যাত্রীদের নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।’
চাক্তাই স্লুইস গেট এলাকার আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর চাক্তাইখালের মুখের ঘাটের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) কর্তৃক ঘাটের ইজারা দেওয়া হয়। চাক্তাই খালের মুখের ঘাটের চলতি বছরের ইজারাদারের দায়িত্বে আছেন ইউসুুফ হারুন মাসুদ নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু তিনি কোন ধরনের ঘাট মেরামত না করে একজন মাছবিক্রেতার মাধ্যমে ঘাটের যাত্রীর খরচ উঠিয়ে নেন। ঐ খরচ দুজনের মধ্যে ভাগাভাগি করেন। জনপ্রতি যাত্রী খরচ ৩ টাকা করে নিলে, এক তৃতীয়াংশ মাছবিক্রেতা পান। বাকিগুলো ইজারাদার হারুন মাসুদ নেন। এভাবে তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হলেও ঘাটের কোন মেরামত নেই। নৌকার মাঝিরা তাই তাদের সুযোগ মতো স্থানে চাক্তাই খালের পাশেই যাত্রী নামিয়ে দেন।’
যাত্রীভোগান্তি ও ঘাট মেরামত সম্পর্কে জানতে চাইলে ইজারাদার ইউসুফ হারুন মাসুদ সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আগে আমার ঘাটটি পাকা ছিল। ঐ ঘাটের পেছনে ৮ লাখ টাকার ওপর লোকসান হয়েছে। স্লুইস গেটের প্রজেক্টের কারণে খালের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা ভেঙে ফেলেছেন। বর্তমান কাঠের ঘাট তৈরি করে যাত্রী পারাপার করছি। আমি এ বিষয়ে চসিককে অনেকবার অভিযোগ করেছি। চসিকের প্রাপ্ত ফি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেছি। আমি চাই, চসিক যেন আমাকে আগের মতো পাকা একটি ঘাট তৈরি করে দিয়ে যাত্রীদের যাতায়াতের সুযোগ করে দেয়।’
ঘাটের অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের ভোগান্তি সম্পর্কে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‘চাক্তাই খালের মুখে ঘাট না থাকলে আমি কি করতে পারি? এসব প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা দেখাশোনা করেন। তার সঙ্গে কথা বলেন।’ চসিক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে মালামাল ওঠানামায় কোন ঘাট না থাকায় এবং স্লুইস গেটের প্রশস্ততা কম হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। চাকতাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এক সময় বিভিন্ন উপজেলায় নৌপথে পণ্য পরিবহন হলেও এখন কেবল কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি এবং সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরে নৌপথে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এছাড়া গত ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চাক্তাই খালের কর্ণফুলী মোহনায় স্লুইস গেট নির্মাণকাজ শুরু করে। সেই সময় চাক্তাই খালের একাংশ ভরাট করার ফলে চাক্তাই খালের কর্ণফুলী মোহনায় পণ্য লোড-আনলোড করতে হতো। তবে গত বছর স্লুইস গেটের একপাশ খুলে দিলে ছোট আকারের নৌকাগুলো কেবল খালে প্রবেশ করতে পারছে। তাই ব্যবসায়ীদের বাধ্য হয়ে ছোট নৌকায় পণ্য নিয়ে সেগুলো বড় নৌকায় লোড করতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এমনিতে নানা কারণে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে নৌপথে পণ্য পরিবহন হচ্ছে ১০ শতাংশের চেয়েও কম। বর্তমানে আমাদের দুঃখ হচ্ছে এই স্লুইস গেট। এটি নির্মাণের আগে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে বসা প্রয়োজন ছিল। স্লুইস গেটের এই ছোট প্রশস্ততায় ব্যবসায়ীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।’
চাক্তাইয়ের বর্তমান ইজারাভুক্ত ঘাট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্লুইস গেট নির্মাণের আগে কয়েকটি ঘাট ছিল। প্রশাসন তা ভেঙে ফেলেছে। বর্তমানে চসিকের ইজারাভুক্ত কোন ধরনের ঘাট নেই। তবে কেউ চসিকের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে যদি বাণিজ্য করে তবে তারা অন্যায় করছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, বর্তমানে বোয়ালখালী বা অনান্য স্থানে পারাপারের জন্য চাক্তাই খাল এলাকায় কোন ধরনের ঘাট ইজারাভুক্ত নেই। এটি নিয়ে দুর্নীতি চলছে ।’
চাকতাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, চাক্তাই খাল দিয়ে শত বছর ধরে নৌপথে সারাদেশের সাথে বাণিজ্য হতো। সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সেটি কমে আসে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দুঃখ হলো স্লুইস গেট। গেটটির প্রশস্ততা এতই সংকীর্ণ যে ছোট নৌকা দিয়ে আমাদের মালামাল লোড আনলোড করে পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী মোহনার ঘাটে আবার বড় নৌকায় তুলতে হচ্ছে। বর্তমান যাত্রী যাতায়াতে যারা ঘাটের ওপর নির্ভরশীল তাদের বিষয়ে চসিকের ভাবা প্রয়োজন মনে করছি।
চাক্তাই ঘাটের বিষয়ে জানতে ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওর্য়াড কমিশনার হাজি নূরল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে পাকা ঘাট ছিল, তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে এরপর সিটি করপোরেশন আর ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আপনারা চসিক রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলুন।’