আবু মোশাররফ রাসেল »
আবদুল গণি ওরফে গণি মিয়া ‘জনগণের বিপুল ভোটে’ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার অবশ্য এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ কোনোকালে ছিল না, আমি কোনোদিন তাকে ‘চেয়ারম্যান হতে চান’ এমন আকাঙ্ক্ষার কথাও বলতে শুনিনি। সরকারি তরফ থেকে যখন নির্বাচনের ঘোষণা এলো গ্রামের মুরব্বী শ্রেণীর লোকজন গণি মিয়ার বাড়িতে আসতে শুরু করলেন। প্রথম এসেছিলেন রমজান চাচা; তিনি বললেন-‘গণি মিয়া, আমাদের এই পাড়া থেকে কোনোকালে কেউ চেয়ারম্যান হয়নি, কেউ ভোটও করেনি। সে কারণে আমরা বারবার অন্য পাড়ার নেতাদের চেয়ারম্যান বানাই, এবার তুমি ভোটে দাঁড়াইয়া যাও।’
তারপর এলেন নুরুদ্দীন মাঝি, তিনিও একই কথা বললেন। এভাবে একের পর এক গ্রামের মানুষের ‘চাপাচাপিতে’ তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষজন তাকে কথা দিয়েছিলেন, ‘ভোটে প্রার্থী হন, আমরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত করব।’
গণি সাহেব গ্রামের মাতব্বর; এটাও অবশ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তার বাবা আজীম আলী গ্রামের মাতব্বর ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর গ্রামের লোকজন এভাবেই একদিন বলে-কয়ে গণি মিয়াকে মাতব্বর বানিয়েছিলেন।
আমি গণি মিয়াদের বাড়ির ‘বিশ্বস্ত কামলা’; ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতে কাজ করছি। প্রতিদিনের বাজার-সওদা থেকে ভিটের পেছনের মাচায় ধরা লাউ-সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রি, গাছে উঠে নারিকেল-সুপারি নামিয়ে আনা, দুধের গাভিটিকে নদী থেকে গোসল করিয়ে আনা, পুকুরে জাল পেতে মাছ ধরে আনা, মসজিদের হুজুরকে ভাত দিয়ে আসা, হুজুরের কাছ থেকে বাচ্চাদের জন্য পানিপড়া নিয়ে আসা—আমার যে কত কাজ! বলে শেষ করা যাবে না। ভোরের সূর্য ওঠার আগে আমার কাজ শুরু হয়, রাতে গণি মিয়া ঘুমিয়ে পড়ার পরও আমার কিছু কাজ থাকে, সেসব শেষ করে ঘুমাতে যাই। মুরুব্বীদের বলতে শুনি-‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ সব আমার দায়িত্ব।
রমজান চাচা গণি মিয়াকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘ভোটে জেতার কাজটি হলো পুলসিরাতের মতো, একটু ভুল করলেই শেষ! ভুল করা যাবে না, সাবধান। সবাইকে আপন করে নিতে হবে, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।’ গণি মিয়া সম্ভবত এটাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে লাগলেন। আমার সাথে তিনি ইদানীং যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করছেন। চায়ের মধ্যে চিনি কম পড়েছে বলে যে লোক মেজাজ হারাতেন সেই লোকের মুখে এখন হাসি আর হাসির বন্যা বয়ে চলে। ভোটের সময়ে আমি যখন বিভিন্ন গ্রামে পোস্টার-ব্যানার ইত্যাদি বিলি বন্টনের দায়িত্ব পালন করছিলাম, তখন গণি মিয়া তার সমর্থকদের কাছে আমাকে তাদের ‘কামলা’ হিসেবে পরিচয় না দিয়ে বলতেন-এ আমার ‘ঘরের মানুষ’। আমাকে দিয়ে কারও কাছে টাকা পাঠাতে গিয়ে বলতেন-‘শওকত নামে একজন টাকা নিয়ে যাবে, আমার ম্যানেজার। নতুনভাবে পরিচিত হতে দেখে আমি মনে মনে সম্মানবোধ করতাম আর ভাবতাম, ‘আহ! ভোটের মৌসুমটা যদি সারা বছরই থাকতো!’
ভোটের দিন এল। গ্রামের মানুষ তাদের কথা রাখলেন, তারা বিপুল ভোটে গণি মিয়াকে নির্বাচিত করলেন। মাতব্বর থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গণি মিয়া আনন্দে আত্মহারা। গ্রামের মানুষজনকে তিনি কীভাবে যে এই ভালোবাসার পুরস্কার দেবেন, কৃতজ্ঞতা জানাবেন তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। রমজান চাচা এসেই বললেন, ‘গণি মিয়া, গ্রামের মানুষজনকে এক বেলা ভালো-মন্দ খাইয়ে দাও, দুটো গরু জবাই করে মেজবান দাও।’ গণি মিয়াও ভাবছিলেন সে রকমই কিছু একটা, গ্রামের মানুষজনকে তো মেজবান খাওয়ানো দরকার, রমজান চাচা যখন বললেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।
আগামী শুক্রবার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান গণি মিয়ার বাড়িতে এলাকার সব মানুষের খাওয়ার আয়োজন বা মেজবানের তারিখ নির্ধারণ হলো। এলাকার গণ্যমান্য মুরুব্বীদের সলাপরামর্শ নিতে বৈঠকে বসলেন গণি মিয়া। বৈঠকে সবার আগে উপস্থিত হলেন রহিম সেখ, আমি তাকে দেখে যারপরনাই অবাক হলাম; কারণ এই রহিম সেখই ভোটে গণি মিয়ার সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছেন! একবার ভাবলাম সেই কথা গণি মিয়াকে বলবো, আবার ভাবলাম ‘ছোটমুখে বড় কথা’ মানায় না। তাছাড়া রহিম সেখ যে বিরোধিতা করেছেন সেটা গণি মিয়াও জানেন। আমি অবাক হচ্ছি-মানুষের ‘চক্ষুলজ্জার মেয়াদ’ এত সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে দেখে! বৈঠকে একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছেন, গণি মিয়া সব বুঝে নিচ্ছেন। রমজান চাচা শুধু একটি কথা বললেন, ‘সবাই যেন খেতে পায়, কাউকে যেন খালি পেটে ফেরত যেতে না হয়।’ হঠাৎ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-‘শওকত, তোমার পরামর্শ কী?’ আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না, তবুও মুরুব্বীদের বৈঠকে আমার নামটি যখন উচ্চারিত হয়েছে কিছু একটা তো বলতে হয়। আমি বললাম, ‘মেশিনের গুঁড়ো মসলার চেয়ে শিলপাটায় পিষে নেওয়া মসলায় খাবারের স্বাদ বেশি হয়। মরিচ-মসলাগুলো শিলপাটায় পিষে রান্নায় ব্যবহার করলে ভালো হবে।’ রমজান চাচা বলে উঠলেন, ‘ভালো কথা বলছো’। সাথে সাথে গণি মিয়া বললেন, ‘তা ঠিক আছে, শিলপাটা আর পিষাপিষির মানুষ তুমি জোগাড় করে নাও।’
গণি মিয়া নিজে হাটে গিয়ে চারটি বড় ষাড় কিনলেন। তার কথাবার্তা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। ভোটের সময় যে লোক অকাতরে, বিনা প্রশ্নে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়েছেন তিনি এখন মসলা কিনতে গিয়েও দরদাম করছেন আর কাউকে কাউকে দাবির চেয়ে কম টাকা দিয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমার কাজ আরও বেড়ে গেছে। মেজবান আয়োজনে ‘বিশ্বস্ত কামলা’ হিসেবে ইতোমধ্যে আমার ওপর প্রচুর দায়িত্ব পড়ে গেছে। তিন কিলোমিটার দূরের কসাই পাড়া থেকে কসাই ডেকে আনা, বাড়ির উঠানে প্যান্ডেল তৈরি কীভাবে হবে, চেয়ার-টেবিল কীভাবে বসবে তা ঠিক করা, মসলা পিষার নারী শ্রমিক জোগাড় করা আরও কত কি!
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে মেজবান আয়োজনের কর্মযজ্ঞ শুরু হলো। গরু জবাই হলো, মসলা-মরিচ বাটাবাটি চলছে, প্যান্ডেলের কাজ চলছে। গণি মিয়া আমাকে ডেকে বললেন-‘শওকত, তুমি আজ ঘুমোতে যাবে না, সারারাত এদের সাথে ‘কাজ করার বাহানায়’ পাহারায় থাকবা। কারণ, এরা সুযোগ পেলেই চুরি করবে। গরুর মাংস কাটার সময় দেখে থাকবা, মসলা পিষার সময় খেয়াল রাখবা, রান্নার সময় সাথে থাকবা।’ এই বলে তিনি ঘুমাতে চলে গেলেন।
আমি চেয়ারম্যান সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। সারারাত এই কাজ সেই কাজ করে, রান্নাটা যেন স্বাদে-মানে ভালো হয় তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। ভোরের আলো ফোটার আগে, বড় বড় ডেক (পাতিল) থেকে মেজবানের রান্নার খুশবো (সুগন্ধ) ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারদিকে। সারারাত কাজ আর পাহারায় কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি, ভাবছিলাম-এই তো কিছুক্ষণ পরে মেজবানের মাংস দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিতে পারবো। সকালের দিকে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমে চোখ বুজে আসছিল সে সময় গণি মিয়া এসে তাগাদা দিতে লাগলেন—মানুষজন খেতে আসবে, তুমি সবাইকে সুন্দরভাবে বসিয়ে দেবে, কারও কিছু লাগে কি-না খেয়াল রাখবে, সমাদরের যেন কমতি না হয়! আমি হ্যাঁ বলে কাজে নেমে পড়লাম। মানুষজন আসতে থাকলো, খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো। রমজান চাচা, রহিম সেখ তারাও গ্রামের মানুষকে সমাদর করে খাওয়াচ্ছেন। গণি মিয়া টেবিলে টেবিলে ঘুরছেন, নিজের হাতে ভাত-মাংস তুলে দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘ভালো করে খাও মিয়া, তোমাদের খাওয়ানোর জন্য গতকাল সারারাত আমি ঘুমাইনি!’
বেলা বাড়ার সাথে মানুষের ঢেউ বাড়তে থাকলো, খাওয়া-দাওয়া চলতে থাকলো। আমি সারারাত কাজ করে বিধ্বস্ত, কিছু খাওয়া হয়নি, খুব ক্ষিদে পেয়ে গেল। তাই আমিও গ্রামের লোকজনের সাথে টেবিলের এক কোণায় বসে পড়লাম। সবার সামনে থালা, বাটিভর্তি সাদা ভাত আর মেজবানের মাংস চলে এসেছে, মাংসের সুঘ্রানে মনটা খাওয়ার জন্য আনচান করে উঠলো। আমি থালায় ভাত নিতে যাবো ঠিক সেই সময়ে রমজান চাচা কোত্থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বললেন, ‘এ্যাই শওকত, তুমি চেয়ারে বসে গেলে? এখনই উঠে যাও! তুমি ‘ঘরের মানুষ’, খেতে বসে গেলে কেন! আগে মেহমানদের খেতে দাও।’ আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না। আমাকে তুলে দিয়ে রমজান চাচা গ্রামের মুরুব্বী শ্রেণীর একজনকে সেখানে বসিয়ে দিলেন। আমার ক্ষুধা কিছুতেই মানছিল না, পরের ব্যাচে আমি আবারও বসে পড়লাম খেতে। এবার কোত্থেকে স্বয়ং গণি মিয়া এসে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমরা ঘরের মানুষ খেতে বসে গেলা! পরে খাওন যায় তো; আগে গ্রামের মানুষজনকে খেতে দাও।’ এবারও উঠে গেলাম। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’-আমি বারবার খেতে বসছি, প্রতিবারই মাতব্বর ধরনের কেউ না কেউ এসে আমাকে তুলে দিচ্ছেন। এরই মধ্যে জুমার আজান পড়ে গেল, বাবুর্চি ঘোষণা দিলেন খাবার শেষ! সবাই নামাজ পড়তে মসজিদে চলে গেলেন। মসজিদের ইমাম সাহেব গণি মিয়ার প্রশংসা করলেন, সবাই মিলে দোয়া করলেন।
পরদিন পাশের দোকানে কী যেন কিনতে গেলাম, সেখানে অনেকের জটলা। আমাকে দেখে মুরুব্বী শ্রেণীর কয়েকজন বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন-‘কাল তোমাদের বাড়ির মেজবানের রান্নাটা দারুণ স্বাদ হয়েছে, মনে হচ্ছে এখনও মুখে স্বাদ লেগে আছে! খেতে খেতে মনে হয়েছে যেন শিলপাটায় মরিচ-মসলা পিষে করা রান্নার স্বাদ!’
আমি কিছু বললাম না, নীরবে গণি মিয়ার বাড়ির দিকে যেতে থাকলাম; আমার তো বাড়ি নেই-আমি কেবলই ‘ঘরের মানুষ’।






















































