গোপন

রেবা হাবিব

রেহানা বেগম কোমল গলায় বললেন, লাবনী, তৈরি হয়ে নাও, কাল ছেলেপক্ষ আসবে।
ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে শুনতেই লাবনী চমকে মায়ের দিকে তাকাল। এখনই তার পুরানো দিনের কথা মনে পড়বে, আর মন তিক্ততায় ভরে যাবে। সে আতঙ্কিত হয়ে মাকে বললো, মা, ছেলেদের দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। কতবার বলেছি, বিয়ে করতে চাই না। আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিয়ে করার কি আছে?
এই বলে লাবনীর চোখে জল চলে আসে। রেহানা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন, কিন্তু কয়দিন ঘরে থাকবি? মেয়েরা তো বিদেশি টাকা। একদিন বরের বাড়ি যেতে হবে। ছেলেরাও তো দূরের শহরের বাসিন্দা, ওরা কিছু জানবে না।
লাবনী বলল, সব সত্য ছেলেদের বলেছ, নাকি। আগে থেকে সব সত্যি বলে দিলেই ঠিক।
মা লাবণীকে চুপ করে দিয়ে বললেন, এমন কথা কেউ কি বলে? আর বলার কি দরকার? চুপচাপ বিয়ে করে ফেলো। বিয়ের পর জানবে, এটা একটা দুর্ঘটনা।
লাবনী বলল, আমার সাথে কি হবে, বুঝতেই পারছ না। তারা এলে সত্যটা জানতে পারবে। তারপর সত্য জেনে প্রতিবারের মতো বিয়ে ভাঙবে। আর কতদিন এই সত্য লুকিয়ে রাখতে পারবে। তারা কোথাও থেকে জানবেই।
বলতে বলতে লাবনীর পুরানো ক্ষতগুলো আবার সবুজ হয়ে গেল। নিজেকে অভিশাপ দিয়ে ভাবতে লাগলো সেই দুর্ভাগা দিনের কথা।
আজ থেকে তিন বছর আগে, লাবনী তার জামা সেলাই করতে দর্জির কাছে যাচ্ছিল। রাস্তার মান্নান তাকে অনুসরণ করতে করতে সে অর্ধেক গন্তব্যে পৌঁছাল। মান্নান বারবার পীড়াপীড়ি করতে থাকে লাবনীকে মোটরসাইকেলে বসতে। লাবনী রাজি না হলে হাত ধরে জোর করে বসাতে থাকে। লাবনী তাকে চড় মারে। মান্নান এই অপমান সইতে না পেরে একদিন লাবনীকে কলেজ থেকে একা এসে ধরে ফেলে। তাকে তার লালসার শিকার করে এবং সেদিন থেকে লাবনীর জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। তার জীবন কলঙ্কিত হয়। পুরানো কথা ভেবে লাবনী ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন লাবনী তৈরি হল। তার পরনে মায়ের সবুজ শাড়ি। চুলগুলো খোলা রেখেছে। আশ্চর্য সুন্দর লাগছে ওকে। ছোটভাই ও মা ঘরে এলেন। লাবনী সাথে সাথে মা আর ভাইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিতে শুরু করে। ছোটভাই বোনের কষ্ট বুঝতে পেরেছে। সে মাকে হেসে বলল, আপাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। ছেলেরা চোখ ফেরাতে পারবে না। এই বিয়ে হয়ে যাবে।
ছেলের কথা শুনে মা বললেন, তোমার মুখের কথা সত্যি হোক। আল্লাহ এই বিয়েটা হয়ে যেতে দিন।
ছেলেপক্ষ এলো। লাবনীকে দেখে ছেলেরা আগ্রহী হলো। লাবনী এতটাই আশ্চর্যজনক সুন্দর যে কেউ তাকে অপছন্দ করতে পারবে না। ছেলেরা বিয়ের তারিখ নিশ্চিত করেছে। বাড়ির সবাই খুশি। মা-বাবা, ভাই আশার আলো দেখল। নির্ধারিত দিনে লাবনীকে বধূ সাজানো হয়। গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে সে। তাকে আজকে আরও অপরূপ দেখাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ঘনিষ্ঠজনেরা। ছেলেদের কিছু নিকটাত্মীয়ও এসেছে। সবাই বরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ছেলেপক্ষ বাড়িতে ঢুকল। তাদের খুব রাগী দেখাচ্ছে।
ছেলের বাবা লাবনীর বাবার ওপর রাগবর্ষণ করে বললেন, আপনারা মিথ্যার ভিত্তিতে সম্পর্ক করেছেন। এত বড় সত্য লুকিয়ে রেখেছেন। আপনাদের বলা উচিত ছিল, আপনার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। মিথ্যা লুকিয়ে মেয়েকে চাপিয়ে দিতে যাচ্ছেন আমাদের ঘরে। ভেবেছেন, আমরা দূরে থাকি, আমরা কিছুই জানতে পারব না। আপনি আমাদের ফাঁদে ফেলেছেন। আমরা এই সম্পর্ক করতে চাই না। আমার ছেলের জন্য মেয়ের অভাব?
ছেলের বাবা নিজের স্বজনদের চলে যেতে বললেন। লাবনীর বাবা মিনতি করতে লাগলেন, এতে আমার মেয়ের দোষ ছিল না। দোষ ছিল গরিবের। পথে আমার মেয়েকে লালসার শিকার করা হলো। আপনারা এভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাবেন না।
লাবনীর বাবা অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কিন্তু মানুষগুলো নরম হচ্ছে না।
ছেলের মামাতোভাই হাসিব লাবনীর বাবা-মায়ের কাছে এসে বলল, আমি লাবনীকে বিয়ে করব।
শুনে ছেলের বাবা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? কি বলছ? আরে বড়ভাই যখন রাজি না, তখন এখানে বা কেন সম্পর্ক করবে? হাজার হাজার মিথ্যা বলছে তারা।
এই বলে তিনি হাসিবের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করেন। হাসিব হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, কিসের অভাব এই মেয়ের? এটুকুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে এই বেচারীর কি দোষ? যে অপরাধ করেছে সে বুকে টান মেরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে দরিদ্র বলে কি তার দোষ সব? কখনও ভেবেছেন, কিভাবে এই পরিবার নিয়ে তার একদিন কাটবে। লাবণীর সাথে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কথা অন্তত আমি জানি। বিয়ের পর যদি এই দুর্ঘটনা ঘটতো? তাহলে কি হতো? আমরা কি করেছি? এই জায়গায় যদি আমাদের বোন-মেয়ে থাকত, তাহলে আমরা কী করতাম? আছে কোনো উত্তর? এটা কি কারোর মেয়ে, বোন না দুর্ঘটনার কারণে? আমরা যদি লাবনীর জায়গায় থাকতাম এবং আমাদের সাথে এমন হতো তাহলে? আজ লাবণীর মা-বাবা মেয়ের জন্য বরভিক্ষা করছে। আসুন, আমরা নিজেদের এই জায়গায় রাখি। যদি কখনও আঘাত পাই, তখন ব্যান্ডেজ করি। যেভাবে ক্ষতকে সারিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আমি লাবনীকে আমার জীবনসঙ্গী বানাতে চাই, না হলে কোনোদিন বিয়ে করব না।
হাসিবের মা এসে বললেন, মেয়েকে আমাদের ভালো লেগেছে। আমার ছেলের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে।