ড. মো. মোরশেদুল আলম »
বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসে নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজের পরিবর্তে তাঁর ধর্ষিত ইমেজটিকেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বহুমাত্রিক। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। চিরাচরিত ইমেজ নির্মাণের একচেটিয়া অভ্যস্ততায় গেরিলা চলচ্চিত্রই একমাত্র ব্যতিক্রম। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সেলুলয়েডের ফিতায় একজন নারীকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক লিখিত নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এ চলচ্চিত্রের কাহিনী গড়ে উঠেছে। ২৫ মার্চের রাতে সাংবাদিক স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা বিলকিস বানু একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বিলকিস এ চলচ্চিত্রের কাহিনীতে কেন্দ্রিয় নারী চরিত্র ছাড়াও মূল চরিত্র। ঢাকায় যে গেরিলা দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালিয়েছে, বিলকিস সে দলের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চালান। নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে জবাইকারী পাকিস্তানের মেজর জামশেদ এবং তার ক্যাম্প আত্মঘাতী বোমা হামলা করে উড়িয়ে দেন। একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী নারী; যিনি তাঁর স্বামীকে বিপদের ভয়ে পত্রিকা অফিসের কাজে বাইরে যেতে বাধা দিয়েছেন, যে প্রক্রিয়ায় স্বামী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি ধীরে ধীরে গেরিলা হয়ে উঠলেন, তার প্রতিফলন ঘটেছে এ চলচ্চিত্রে। ঢাকায় বিলকিস বানুর গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং এক পর্যায়ে ঢাকা ছেড়ে নিজ গ্রামের দিকে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে এ চলচ্চিত্রের কাহিনী অগ্রসর হয়।
ট্রেনে করে ঢাকা ছেড়ে বিলকিস নিজ গ্রাম জলেশ্বরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ট্রেনের ছন্দে ফ্ল্যাশব্যাকে বিলকিসের বিয়ের পর স্বামীর সাথে ফেরার স্মৃতি, বিলকিসের বন্ধুদের সাথে তাঁর স্বামীর নৌকা ভ্রমণের স্মৃতি, নৌকায় বসে মৃত মানুষের লাশের গন্ধে বমি করা, শিশুর সাথে তাঁর খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, পথে পথে রাজাকারদের বীভৎসতা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, নির্বিচারে হিন্দুদের হত্যা, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ, মুসলিম নামের কারণে রাজাকারদের বিশেষ সুবিধালাভ এগুলো দর্শকরা বিলকিসের চোখে দেখতে পায়। ট্রেনে বোরখাহীন নারীর অপমানের প্রতিবাদে বোরখা খুলে ট্রেনের জানালায় নিশ্বাস নেওয়া, সবার চোখের সামনে অমুসলিম নারীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেয়া, ছোটভাই খোকনের সাথে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর ফ্ল্যাশব্যাক এবং ফ্ল্যাশব্যাক থেকে শিশু খোকনের নৌকার বর্তমানের খোকন কমান্ডারের নৌকায় রূপান্তর, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে প্রিয় খোকনের জবাইয়ের খবর শোনার পর শুঁটকির গুদামে লুকিয়ে থাকা বিলকিসের বিভ্রমÑ এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা মানসিক সংকটের আবেগী ও জরুরি উপস্থাপন দেখি, যার ধারক ও বাহক বিলকিস।
বিলকিস বানু এবং তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সাহসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঢাকার গেরিলা যুদ্ধে ছাত্র, তরুণ, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ ও তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক নানা তৎপরতা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী উপস্থাপিত হতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গেরিলা বাহিনীর একজন সদস্য ধরা পড়ে অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে সে গেরিলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের নাম বলে দেয়। তাই বিলকিস বানু ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে রংপুরে নিজ গ্রাম জলেশ্বরীর দিকে অগ্রসর হয়। তাঁর এ যাত্রাপথে পাকস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচার, নির্যাতন ও বর্বরতা আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের দৃশ্যাবলি বিলকিস বানুর মাধ্যমে পরিচালক দর্শকদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। নির্মাতা তাঁর এ অভিযাত্রার মাধ্যমেই যেন শহর এবং গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সংযোগসূত্র স্থাপন করেছেন। পরিশেষে জলেশ্বরীতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে বিলকিস বানুর আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গ করার বীরোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে এ চলচ্চিত্রের কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে।
গেরিলা চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র বিলকিস নিজে সরাসরি গেরিলা যোদ্ধা নয়, সাহায্যকারী, তাছাড়া একটি মাত্র অভিযানে অংশ নেয়া ছাড়া আর কোনো গেরিলা অভিযানে বিলকিসকে দেখা যায় না। ছবির প্রথম অংশে বিলকিসকে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী হিসেবে, এটা নগরে। আর দ্বিতীয় অংশে, গ্রামে, এক মুক্তিযোদ্ধা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের এমনভাবে অংশগ্রহণকারী নারীর দেখা আগে পাওয়া যায়নি। বিলকিস নামের এই নারীর মতো অসংখ্য মানুষের সথাসাধ্য সহায়তা ও সমর্থনের জোরেই একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধারা সাফল্য পেয়েছিলেন। তাই বলবো বিলকিস হয়তো রণাঙ্গণে সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু এ ধরনের গেরিলা যুদ্ধে যারাই সাধ্য মতো এগিয়ে এসেছে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে, তারা সকলেইতো যোদ্ধা, গেরিলা। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রতিনিধিত্বশীল বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের কাহিনীই গ্রামভিত্তিক। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা শহরের থমথমে আবহটি কিছুটা পরিলক্ষিত হয় হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) চলচ্চিত্রে। কিন্তু সে সময় ঢাকাসহ সমগ্র দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের যে সম্মিলিত তাণ্ডব, সেরকম প্রতিনিধিত্বশীল কোন চলচ্চিত্র আজও নির্মিত হয়নি। সেদিক থেকে সারা দেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার একটি প্রতিনিধিত্বশীল অংশকে পরিচালক গেরিলা চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ যতটা না যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধ তার চেয়ে বেশি ছিল জনযুদ্ধ। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই স্বাভাবিক জীবনের ছদ্মবেশে গেরিলাযুদ্ধ করেছেন। এ চলচ্চিত্রের বিলকিস চরিত্রের মাধ্যমে নির্মাতা গেরিলাযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নারী নির্মাতা, নারী কাহিনীকারদের চলচ্চিত্রে যুদ্ধশিশু বা নারীর পরোক্ষ অবদানের প্রসঙ্গটি কিছুটা এলেও নারীকে ঠিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখা যায়নি। এসব চলচ্চিত্রে ধর্ষিতা নারীকে হয় পাগল হতে হয়েছে অথবা মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এমনকি প্রামাণ্যচিত্রগুলোতেও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা সরাসরি দেখানো হয়না। বীরত্বের পরিবর্তে নারীদের ওপর নির্যাতনের চিত্রই অধিক প্রদর্শিত হয়েছে। গেরিলা চলচ্চিত্রটি সেদিক বিবেচনায় ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ঐতিহাসিক এ অবদানকে বিবেচনায় না রেখে গেরিলা চলচ্চিত্রের আলোচনা বা সমালোচনা খণ্ডিত হবে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রাক্-স্বাধীনতাপর্ব, মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী কাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর প্রত্যেকটি নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গেরিলা’র আগে কোন চলচ্চিত্রেই নারীকে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে দেখানো হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের যে ভূমিকা সেটি অন্য যে কোনো মুক্তিকামী জাতি বা গোষ্ঠীর গেরিলা চরিত্র থেকে আলাদা নয়। গেরিলা যোদ্ধারা একটি যুদ্ধজয়ের বুনিয়াদ রচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও গেরিলারা সেই কাজটি করেছেন অসীম সাহসিকতায়। দুঃখের বিষয়, তাদের ছিনিয়ে আনা জয় বেহাত হতে হতে আজ অপরিচিতপ্রায়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের চল্লিশতম বছরে মুক্তি পায় নাসিরউদ্দীন ইউসুফ-এর চলচ্চিত্র গেরিলা।
গৃহবধূ বিলকিস থেকে গেরিলা বিলকিস, এই যে পরিবর্তন, ঢাকা থেকে জলেশ্বরীর পথে সাধারণ মানুষের আহাজারি, বিলকিসের মনের ভেতর ক্ষোভ দানা বাধতে থাকা, স্বামীর নিখোঁজ থেকে শুরু করে ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু; ক্ষোভ, প্রতিহিংসা আর মুক্তির আকাক্সক্ষায় শেষ দৃশ্যে শত্রুকে হত্যা ও নিজের আত্মহত্যা, সবটা আমরা জানি, একাধিক ফ্ল্যাশব্যাক ও ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে। যেহেতু অনেকগুলো বিষয় এ চলচ্চিত্রে একসাথে উপস্থাপন করা হয়েছে; এর সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই আছে। সুবিধা হচ্ছে: মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং এর বহুমাত্রিক উপাদানগুলোকে দেখানো হয়েছে, ফলে যে প্রজন্ম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বা সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি তারা ইতিহাসের এসব উপাদানকে প্রথমবারের মত দেখার সুযোগ পাবে। আর অসুবিধা হচ্ছে: এত বিষয় উপস্থাপন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনীর খেই হারিয়ে গেছে, চরিত্রগুলোর উপস্থিতির ধারাবাহিকতা থাকেনি; ফলে চিত্রনাট্যের ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছে। নাসির উদ্দীন এবং শিমুল ইউসুফের বাংলাদেশের মঞ্চনাটক ঋণী সে বিষয়ে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। কিন্তু তাঁদের মঞ্চনাটক সাধনা ক্ষেত্রবিশেষে বাদ সেধেছে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রটিকে একটি উচ্চস্তরের শিল্পমানে পৌঁছাতে। ফলে ছবি দেখার শেষে সিনেম্যাটিক রেশ আর থাকে না। ছবিটা হয়ে ওঠে যুদ্ধকালীন অনেক ঘটনার বাস্তবোচিত খণ্ডচিত্রের সমাহার। মঞ্চনাটক আর চলচ্চিত্রের ভাষা যে ভিন্ন, সেটি বোঝানোর জন্য এ ছবিটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কাবেরী গায়েন বলেন, ‘এ যাবৎকালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে গেরিলাই সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বশীল। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটনাকে আধেয়গতভাবে ধারন করলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে, মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার সঙ্গে এ ঘটনাবলির যোগসূত্র স্থাপিত হয় না বলে কিছুটা অস্বস্তি থেকেই যায়। এবং অপেক্ষা করতে থাকি মুক্তিযুদ্ধের ছবিটির জন্য।’
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়