‘গুপ্ত গান প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারণ করে অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মের কুসংস্কারে আঘাত আনতে চায়’

শেখর দেব »

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত কবি শেখর দেবের কবিতাগ্রন্থ গুপ্ত গান নিয়ে কবির সাথে কথোপকথনের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো। রনি চক্রবর্তী।

রনি চক্রবর্তী: গুপ্ত গান নামকরণের কারণ?
শেখর দেব: কবিতাগ্রন্থটি গীতার বিষাদ যোগ অবলম্বনে। হাজার বছর ধরে যে বইটি ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। গভীর অভিনিবেশের ফলে বইটির ভেতরের গূঢ় দর্শন সম্পর্কে জানা যায়। গীতা পড়লে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যুদ্ধ ময়দানের গল্প অথবা কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন। আসলেই কি তাই?
ভারতীয় উপমহাদেশের যোগ (ণড়মধ) দর্শন বা প্রণালী আজ বিশ্ববিদিত। যোগ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা কৌশল যার মাধ্যমে একজন নিজের মনকে স্থির করে সচেতন জীবন যাপন করতে পারে। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের বালাই নাই, আছে শারীরিক ও মানসিক চর্চা।
যোগের সেই গুহ্য বিদ্যা গীতার মধ্যে লুকায়িত আছে। গুপ্ত গান বইয়ে সে গুপ্ত বিদ্যায় আলো ফেলতে চেয়েছি। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের চর্যাপদ আর মধ্যযুগ তো গানের সমারোহ। হয়তো কবিতা থেকে গান এখন আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু কবিতার দেহে যেন সতত গানেরই প্রবাহ। পয়ার ছন্দে লিখেছি তাই গান শব্দটি এসেছে বইয়ের নামে।
রনি চক্রবর্তী: ২০২৪ সালে এসে শ্রীমদভগবদগীতা কেনো উপজীব্য হলো?
শেখর দেব: সভ্যতার বিকাশ যুদ্ধ ও সংঘাতের মাধ্যমে। প্রাচীন কালে আমরা যা দেখেছি বর্তমান সময়ে তার ব্যাতিক্রম কোথায়? চারদিকে মানুষে মানুষে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ ও সংঘাত চলমান। অথচ আমরা চাই প্রগতি, উন্নয়ন, পরিবর্তন ও বৈষম্য ও সংঘাতহীন পরস্পরের সৌহার্দপূর্ণ সমাজ। কিন্তু তা কি হচ্ছে? এর কারণ ব্যক্তি মানুষের অস্থিরতা ও সক্রেটিসের কহড়ি ঃযুংবষভ -এর মর্ম বোঝার অক্ষমতা ও অপারগতা।
গীতায় সে দর্শনের খোঁজ পাওয়া যায়, যা মানুষকে জানতে সাহায্য করে আমি কে? গুপ্ত গান তাই ২০২৪ সালে এসেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যোগ নিজেকে জানার দর্শন। নিজের আত্মোপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাজাত এই অনুভব।
রনি চক্রবর্তী: রচনা করতে গিয়ে মধ্যযুগের পয়ার ছন্দ কেনো বেছে নিলেন?
শেখর দেব: ছন্দ কি পুরনো হয়? মধ্যযুগের সাহিত্যে পয়ার ছন্দ বহুল ব্যবহৃত হয়েছে তা ঠিক। আমার কাছে পয়ার ছন্দটা খুব কমিউনিকেটিভ মনে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাহিত্য মানুষের কাছে না গেলে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ। সাহিত্যের মাধ্যমে শিক্ষা বিতরণ আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য পুরনো বিষয় নতুন মাত্রায় উপস্থাপন। যা পুরনো হয়েও চিরন্তন। গুপ্ত গান-এ সাহিত্যের বিষয়ে কোন কম্প্রোমাইজ করিনি পাঠকের সাথে। শুধু ছন্দটাকে নিয়েছি কারণ বাংলায় এ ছন্দের জনপ্রীতি আছে।
রনি চক্রবর্তী: প্রথাগত গীতা থেকে গুপ্তগানের পার্থক্য কি?
শেখর দেব: গীতার অনেকরকম ব্যাখ্যা আছে। প্রথাগত গীতার শ্লোকগুলো কখনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে-এর দার্শনিক ব্যাখ্যার। বিভিন্ন দার্শনিক জায়গা থেকে এর ব্যাখ্যা হয়েছে। তেমন একটা দার্শনিক ভিত্তি হল যোগ(ণড়মধ)। কিন্তু গীতার শ্লোক ও এর ব্যাখ্যা যুগপৎ কবিতার ছন্দে প্রকাশ করার বিষয়টি আর দেখিনি। গুপ্ত গান-ই সম্ভবত প্রথম ও নতুন। এই জায়গায় এর তফাৎ। গুপ্ত গান গীতার ভেতর লুকানো অন্তর্নিহিত গূঢ় দর্শনকে তুলে এনেছে।
রনি চক্রবর্তী: এই বই বর্তমান পাঠকদের কী মেসেজ দেবে?
শেখর দেব: গুপ্ত গান বইটি কোন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্দি রইলো না। কারণ গুপ্ত গান পড়তে কোন বিশ্বাসের প্রয়োজন পড়ে না। এ দর্শন বৈজ্ঞানিকভাবে সিদ্ধ ও চর্চার বিষয়। চর্চার মাধ্যমে এর অন্তর্নিহিত দর্শন বোধগম্য হয়। তবে গীতার মূল টেক্সট না পড়লে গুপ্ত গান-এর কবিতার সাথে গীতার পার্থক্যটা ধরা দূরহ হবে।
রনি চক্রবর্তী: মুখবন্ধে অপরোক্ষ জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি যদি পরিষ্কার করেন।
শেখর দেব: প্রাক-কথনটি লিখেছেন একজন যোগ-বেদান্ত আচার্য। গীতার মূল টেক্সট ও দার্শনিক ব্যাখ্য যাঁর নখদর্পনে। গীতা নিয়ে গবেষণা ছাড়া আমার কবিতার টেক্সট ভালোভাবে উপলব্ধি করা কঠিন। ৯৯’ গীতা পড়া পাঠকের এটা নতুন বিষয় মনে হবে।
তিনি অপরোক্ষ জ্ঞানের কথা বলেছেন। অপরোক্ষ শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় একটা বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় দর্শনে জ্ঞানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অপরোক্ষ জ্ঞান। অপরোক্ষ জ্ঞান মূলত ইন্দ্রিয়াতীত অভিজ্ঞতা এবং পরম্পরার মাধ্যমে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এ জ্ঞানের সাথে ধর্ম বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নাই।
রনি চক্রবর্তী: এই বইটি প্রগতিশীলতাকে কতটুকু সমর্থন করবে?
শেখর দেব: প্রচলিত সমাজের অন্ধ বিশ্বাস, রাষ্ট্রীয় শোষণ ও সমাজ সংস্কারের বিষয়গুলোর প্রগতিশীলতার সাথে সম্পৃক্ত। যার পজেটিভ পরিবর্তন হলো প্রগতিশীলতা। গুপ্ত গান নেগেটিভ পরিবর্তন ও অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।
গুপ্ত গান গীতার প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিতে চায়। ব্যক্তি মানুষের পরিবর্তন একটা সমাজ, জাতি রাষ্ট্রের পজেটিভ পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। গুপ্ত গান ব্যক্তি মানুষের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। অর্থাৎ গুপ্ত গান প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারণ করে অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মের কুসংস্কারে আঘাত আনতে চায়।
ধন্যবাদ আপনাকে।