হাফিজ রশিদ খান »
নতুন খ্রিস্টীয় নববর্ষে আজ থেকে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি। এর আগের বছরটিতে আমাদের বহু আশা-প্রত্যাশা যেমন সঠিক পরিপ্রেক্ষিত, সাচ্চা পরিচর্যার অনুপস্থিতিতে অনেকটাই তামাদি হয়ে গিয়েছিল, তেমনি নতুন বছরটিকে ঘিরে দুর্বলের মন না-মানা প্রত্যাশার মতো আবারও পল্লবিত হয়ে উঠতে চাইবে অনেক-অনেক চাওয়া-পাওয়ার নতুন মনোবৃক্ষটি। মনে পড়ছে প্রবাদবাক্যসম কোনো এক জ্ঞানিজনের একটি বচন : ‘মানুষ তার আশার সমান বয়সী’। কথাটিতে একটি বেগানা আভিজাত্যের মতো দূরবর্তী সান্ত¡নার প্রলেপ থাকলেও ওতে মন না-মজিয়ে উপায়ও-বা কী! দেশটাকে যে আমরা সকলেই ভালোবাসি, তাতে বিন্দুমাত্র আঁচড় না-দিয়েও বলা যায়, এ ভালোবাসা প্রকাশে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সঠিক ও সাবলীল ধরনের প্রকাশভঙ্গিগত বিপুল ঘাটতি মনে একধরনের নেতিবাচক এত্তেলা জমা রেখে যায় নীরবেই। কখনো-সখনো এই নঞর্থকতায় মনটা ভারী ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
গভীরের মনটি বুঝ পায় না, বছরে-বছরে কেন আমরা তামাদি দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে কাইজা-ফ্যসাদে লিপ্ত হই প্রায়শই? দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে, এমন ভাবনা ছাড়া আর কীই-বা উদিত হয় মনে? স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মানসিকতাকে আমরা সমমাত্রিক চেতনার অংশ হিশেবে নির্মাণ করে নিতে সক্ষম হইনি আজও। দুটোতেই আমরা রয়েছি যেন বারঘরের ক্ষণিকের অতিথি হয়েই। আমাদের বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার অনুভূতি ভূখ-গত জনমানুষের বৈষয়িক বা ইহজাগতিক সমৃদ্ধির গ্যারান্টি দিতে বহু বেশি সময় নষ্ট করে ফেলছে বলে মনে হয়।
কেন জানি মনে হয়, একটা প্রকা–নির্লিপ্ত, বিমূর্ত ধারণার ভেতরেই আমাদের স্বাধীনতার বোধটি নিস্তেজ হয়ে আছে। আর গণতন্ত্র বিভিন্ন সময়ে, বর্ষে-বর্ষে, নতুন নতুন পোশাক পরে আবির্ভূত হয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের বনেদি রুচি-সংস্কৃতির গায়ে কেবলই ঘা দিয়ে যাচ্ছে সজোরে, ‘এই, আমাকে চেন না বুঝি?’ এ থেকে আমাদের সত্যসন্ধ, সহজ, মানবিক মুক্তি কবে আসবে, কে জানে। তার ভেতরেই এলো কোভিডকালের ছোবল। এ যেন সবকিছু ভেঙে পড়ার দশা। তবে এ শুধু আমাদের দেশ নয়, এটি বৈশ্বিক বিপর্যয়ও বটে। দেশে এটি আহার-বিহার ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে একধরনের দুঃখজনক স্থবিরতা এনে দিয়েছিল। সার্বক্ষণিক শংকাও আতংকের অনুভূতি নিয়েই চলছে জীবনকে বয়ে নেওয়ার দুর্মর প্রয়াস।
এ অবস্থায় নৈসর্গিক নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম না-ঘটিয়ে, প্রকৃতিকে সাজিয়ে চলে এসেছে খ্রিস্টীয় নববর্ষ। এদেশে বাঙালি জাতিভুক্ত এবং ধর্মবর্ণনির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলী মানুষের মধ্যেও খ্রিস্টীয় নববর্ষটি বরণের একটি সচেতন ও সমাজবদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা রয়েছে, এ আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। যদিও এটির সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো যোগ নেই।
এই নববর্ষবরণের ধাতটি স্রেফ ‘বল্গাহারা অশ্ব’ যেন। কাজেই খ্রিস্টীয় নববর্ষের দ্যোতনাটিকে একান্ত ব্যক্তিগত আবলোকনে হাজির করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ এ নববর্ষের যাপনায় এদেশের গণমানুষের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সম্পৃক্তি নেই বললেই চলে। তারপরও এই উচ্ছ্বাস, এই ধাবমান স্পৃহাকে রাজনীতির আয়নায় দেখার একটা গৎ বা রীতি এদেশের এলিটদের মধ্যে খুবই সুলভ। অনেকটা একেবারে নাছোড়প্রবণতার মতো। কেননা তারা এদেশের শ্রমজীবী মানুষ, এদেশীয় সম্পদ- মৃত্তিকায়, বনের গর্ভে, সাগরের তলদেশে যা আছে, তার ওপর মেধা ও কার্যকর সামর্থ্যে বলীয়ান নয় তেমন। এসবে কর্তৃত্ব রাখতে হলে যে দেশপ্রেমিকতা, স্বকর্মনিষ্ঠা ও ত্যাগ ও তিতিক্ষার ধ্যানী সৌন্দর্য দরকার, তা কামাই করতে এরা বংশপরম্পরায় পরাক্সমুখ। তারা চোখ বড় করে, নিউরনে আলোড়ন তুলে, প্রায়শ হাত বাড়িয়ে থাকেন বিদেশি মেধার কর্তৃত্বের দিকে। এবং তা বেশির ভাগই পশ্চিমা দুনিয়ার দরবারে সম্পন্ন হতে দেখা যায়।
তাহলে বোঝা গেল, বিদেশিরা আমাদের সম্পদ-সামর্থ্যের কুলুজি আমাদের চেয়ে ঢের বেশি রাখে। ওরা তো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির স্তর মাড়িয়ে আরো বহুদূর অলিম্পাসে বসবাস করে আসছে রেনেসাঁ, আলোকায়নের পথে-পথে ঘাম ঝরিয়ে-ঝরিয়ে। কাজেই খ্রিস্টীয় নববর্ষের উছিলায় আমাদের সমাজের ওপরমহলে যে প্রবল একটা পরমুখাপেক্ষী উৎসব ও আনন্দের ঝড় বয়ে যায়, তা তো অনর্থক নয়! এই দিনটাকে ঘিরে বিনিময় ঘটে নতুন-নতুন তেজারতি, উজারতির উমেদারিও, এমন কি উত্তেজনার আলগা রসদও। সেখানে যে ক্ষমতার মসনদে সমাসীন হওয়ার খোয়াব, আর মসনদ অটুটু রাখার চাণক্য চাল সদা মশগুল থাকে না, কে আর নিশ্চিতভাবে এ প্রত্যয়ের বিপক্ষে দাঁড়াবে ?
এই তো আমাদের ক্ষমতা-অধ্যুষিত জনসেবকসংঘের কীর্তিকলাপ। এর পক্ষে এন্তার দৃষ্টান্ত এখান-ওখান থেকে ঘেঁটে স্তূপ করা যায়। আশা করি তার প্রয়োজন নেই এ কারণে যে, আমাদের সকলেরই মানসিক অবস্থা তো আসলে সেই ভাওয়াইয়া গানটির মতোই, ‘কি কহিব আমার দুষ্কের কথা রে … ’। উল্লেখমাত্রই যা হৃদয় ও মস্তিষ্কে তুফান বয়ে দেয়।
বলছিলাম, এ নতুন বছরে আমাদের অনেক আশাই গোর হয়ে গেছে, আবার কিছু আশা পল্লবিত হয়ে উঠতে চাইছে দুর্দান্ত সাহসে। এই মহানগর চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রসঙ্গেই বিষয়টার কিঞ্চিৎ বিস্তার করা যাক।
এ নগরই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে পরিচিত। এটি আমাদের পূর্বপুরুষের কর্মমুখর, সরব পদচারণায় ধীরে-ধীরে প্রাণ পাওয়া আশ্চর্য-সুন্দর, দরদি, সকলকে নিয়ে চলার ঐতিহাসিক জনপদ। বিভিন্ন জাতি ও তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে আকর্ষক এ চট্টলভূমি। যেকোনো বিবেচনায় তার সময়োপযোগী প্রার্থিত উন্নয়ন-পরিকাঠামো না-পেয়ে কেমন যেন অবহেলিত পরমার মতো ভারি সংকোচে দিন পার করে দিচ্ছে এ নগর। বড়গলায় অভিযোগেও তার যেন রুচি নেই তেমন। কারণ তাকে অবহেলাকারীরাও যে তার স্বজন, সগোত্রীয়, একেবারে ঘরেরই মানুষ। তবে ইদানিন্তন সময়ে এই নগরে, বিশেষ করে খোদ নগরকে কেন্দ্র করেই আসলে, এক বিশাল দক্ষযজ্ঞ কা- শুরু হয়েছে চারদিকে। তাও অবশ্য উন্নয়নের নামেই। যা কিনা এই নগন পরমার তুষ্টিসাধনের একটি বহু বিলম্বিত পদক্ষেপ বটে। এর একটি হলো ফ্লাইওভার নির্মাণ। এটি নিয়ে নগরবিশারদদের মধ্যে আবার আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।
তাদের কেউ-কেউ এমনও বলছেন : এ প্রয়াস উপকার করবে কাদের? ফ্লাইওভার তো বড় মানুষের, বড় বড় গাড়ির চলনভঙ্গি সহজ করার বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ উদ্যোগ। এখানে অত-অত পুঁজিধারী আছেনই-বা ক’জনা? অন্যদিকে উদ্যোক্তারা বলছেন : এ হলো ভবিষ্যতের বড় চট্টগ্রামের জন্যে আগাম চলার পথ তৈরি করার আয়োজন। এতে সহজ-সরল নাগরিকমন খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে দ্রুতই। ভাবে, মন্দ কী ? পরক্ষণেই আবার মনে জাগে তার, এইসব দেখতে-দেখতেই অবশ্য, যে, ফ্লাইওভার এ নগরের খোলামেলা পরিবেশ-প্রতিবেশটাকে কেমন আঁধার-আঁধারে ঢেকে দিচ্ছে না তো? একটা কেমন বদ্ধতার ভেতর নিয়ে যাচ্ছে না তো আমাদের? জানে না সে এর প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা। ভাবে আরও, নগরযাপনে অনেক ত্যাগও তো দরকার! সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ এর ‘মেট্রোপলিটন মন বিদ্রোহ’ নামক বইয়ে যার কিছু উল্লেখ আছে।
এসব বাদ দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আরও একটি বিষয় সামনে আনতে চাই এই নতুন বছরে। নগরের সড়কগুলো তো বেশ প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে ভালোই-ভালোই। কিন্তু কোথাও-কোথাও বেশ বেঢপভাবে ছাড় দিয়েই যেন। এ কেনো? অর্থাৎ সড়ক প্রশস্ত হতে-হতেই কোনো-কোনো জায়গায় এমন বেঁকেচুরে গেছে যে, প্রশ্ন জাগে : ভবনমালিকেরা কি উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠান বা সরকারি নীতিমালা অমান্যে আরও বড়, আরও ক্ষমতাধর? সেই সাথে আরো দেখি, সড়ক প্রশস্তকরণের কারণে ওটা তো বেশ ওপরেই ওঠে যাচ্ছে আগেকার অবস্থান থেকে। অথচ ওই সড়কগুলোর পাশেই রয়েছে বিভিন্ন মহল্লার গলি-উপগলিপথ। নগর জনপদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলিষ্ঠ, যৌথ কণ্ঠস্বর ওরা। ওদের জীবনযাপন আয়-রুজি, এসবই জড়িত ওই প্রশস্ত হওয়া সড়ক ঘেঁষেই। অথচ এর পাশের গলি-উপগলির রাস্তাগুলো একেবারেই থেকে গেছে ‘যথা পূর্বং তথা পরং’।
অর্থাৎ তিন-চার মিটার নিচে প্রায়। এ এক ভয়াবহ দৃশ্যপট। যদি নগর বিশারদগণ তা খেয়াল না-করে থাকেন, তবে স্বচক্ষে তা পরিদর্শন করা হোক অনতিবিলম্বে। এ থেকে জনসেবার নিশ্চিত নতুন ধারণা বেরিয়ে আসবে। তা হলো, ওই যে আসছে ভৈরব হরষে সেই বর্ষাকাল। তার বেপরোয়া জলধারা ওই গলি-উপগলির ঘরবাড়িতে আর নিচু থেকে আরো নিচুতে অবস্থান নেয়া নর্দমায় খুবই স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলবে আরামে জনপদ-দূষণের মওকা পেয়ে। কেননা নর্দমাগুলোর কোনো সময়োপযোগী সংস্কার তো হচ্ছেই না যুগ-যুগ ধরে।
নতুন বছর আমাদের জন্মশহরটাকে নতুন কোনো স্বপ্নের উচ্চতায় দাঁড় করাতে পারবে কিনা জানি না। তবে আমাদের প্রবল আশা, নতুন বছরে আরও সব নতুন-নতুন উন্নয়ন ও তার ইতিবাচক প্রভাবে এ নগর হাসবে।