আবদুল মান্নান
সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ বা করোনার সাথে পাল্লা দিতে দিতে ক্লান্ত তখন বাংলাদেশ আর এক ভাইরাস দ্বারা সবার অলক্ষ্যে চরমভাবে আক্রান্ত, এই ভাইরাসের জন্মদাতা এই দেশেরই কিছু মানুষ যাদের আবার সমাজে বেশ প্রতিপত্তি আর হাঁকঢাক । তাদের সাথে আবার কিছু সিঁধকাটা ছিচকে চোরও আছে । ছিঁচকে চোররা মাঝে মাঝে সমাজে কিছুটা হলেও অপদস্থ হয়, ভাগ্য খারাপ হলে কারো কারো জেল জরিমানাও হয়, কিন্তু বড় ডাকাতরা সব সময় অধরা থেকে যায়, কারো কারো সরকারি বড় পদায়ন হয়, কেউ হন সংসদ সদস্য আবার কেউ মন্ত্রী আমলা । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন না তাঁর কোন শত্রু থাকতে পারে । নিজের জীবনের বিনিময়ে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে । তিনি যাদের বিশ্বাস করতেন তারাই প্রথম ছোবলটা মেরেছিল ।
একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য অনেক কাছের ও দূরের মানুষের উপর নির্ভর করতে হয় । এদের মধ্যে কাছের একজন মানুষও যদি নষ্ট চরিত্রের হয় তা হলে ঘটে যেতে পারে বড় সর্বনাশ, বিপদে পড়তে পারে রাষ্ট্র । ফাতেমা প্রধানমন্ত্রীর অফিস সহকারি । অত্যন্ত ছোট মাপের কর্মচারি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রধানমন্ত্রীর অনেক গোপন নথি তার হাত দিয়ে যায় । সে যদি তার উপর রাখা দায়িত্ব সামান্য বরখেলাপ বা পালতে দূর্নীতির আশ্রয় নেয় তা হলে বদলে যেতে পারে প্রধানমন্ত্রীর অনেক বড় যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত । তাই ঘটলো কয়েকদিন আগে ।
দেশের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় যার পড়ালেখা নিয়ে কোন অভিযোগ নেই তবে প্রায়শঃ নানা স্ক্যান্ডালের জন্ম দেয় তার কয়েকজন পরিচালক । সংখ্যায় এরা পনেরজন বোর্ড মেম্বারের মধ্যে চার থেকে পাঁচজন । বাকিরা বোর্ডে তেমন সক্রিয় নন কারণ তারা বাকি পাঁচ ছয়জনের কর্মকাণ্ডে বেশ বিরক্ত । বিভিন্ন সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বোর্ড মেম্বারদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে । তদন্ত হয়েছে । তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে কিন্তু ওই প্রতিবেদনের মৃত্যু ওখানেই হয়েছে । একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কন্যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন । তিনি একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেন । তদন্ত হলো । অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলো । প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হলো । তারপর শেষ কারণ এই ক’জন পরিচালকের হাত অনেক দীর্ঘ, যোগাযোগ সরকারের অনেক রাগব বোয়ালের সাথে । সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একমতো নিখরচায় পড়ালেখা করে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সন্তানরা ।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস সহকারি ফাতেমা যে অপকর্মটি করেছে তা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে যে ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপিত হয় সেই ফাইলটাতে মঞ্জুরী কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাকে সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীও তার নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়েছেন । তিনি অবশ্যই সব দিক হতে যোগ্য । ফাইলটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে । চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি তাতে অনুমোদন দেবেন । প্রধানমন্ত্রী যার নাম প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছেন সেটি বোর্ডের সদস্যরা জেনেছেন কারণ সর্বত্র তাদের অবাদ । তাদের চারিদিক সব বশংবদ লোকজনে ভর্তি। ব্যতিক্রম আছে কয়েকজন । প্রধানমন্ত্রীর প্রাধমিক প্রস্তাব বদলে দিতে হবে । কুতুবরা দ্বারস্থ হলেন ছাত্রলীগের এক নেতার সাথে । তাদের অনেকের অবাধ প্রবেশ আছে গণভবনে বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে । সেই ছাত্রনেতার সাহায্যেই ফাতেমা এই কাজটি করেছে । প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ফাতেমার সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবর্তন হয়ে তৃতীয়জনের নাম রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয় এবং সেই ভাবেই তা চ্যান্সেলর অনুমোদন দেন । অবাক হয় সকলে । একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে কি ভাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হলো এই নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে জালিয়াতিটা ধরা পরলে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একজন দায়িত্বশীর কর্মকর্তা আদালতে মামলা করেন এবং ফাতেমা ও সেই ছাত্র নেতা আদালতে তা স্বীকার করে । এমন ঘটনা এই প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে তা নয় । এর আগে উপ-উপাচার্যের নিয়োগ নিয়েও তারা তেমন একটা কা- করতে চেয়েছিলেন পারেন নি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দৃঢ়তার কারণে । তখন একজন বোর্ড সদস্য নাকি বলেছিলেন সবাইকে কিনতে পারলেও মঞ্জুরী কমিশনের চেয়্যারম্যানকে কেনা গেল না । সেই বোর্ড সদস্য দূর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন । তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে সরকারের সত্তর একর জমি দখল করার অভিযোগও আছে ।
উচ্চ শিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় খাত । এমন বেশ কয়েকটি ভাল কাজ করছে । তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ কখনো উঠেনা । কিন্তু উল্লেখিত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে এই খাতটি প্রায়শঃ দূর্নামের ভাগি হয়, মানুষের আস্থা হারায় । একজনের কাছে এক বার জানতে চেয়েছিলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস্ মিডিয়ায় প্রচারিত হয় তারপরও কেন তাদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না । উত্তরে তিনি বললেন কখনো হবে বলে বিশ্বাস করিনা কারণ তাদের অনেকের সাথে প্রাধানমন্ত্রীর অনেক বিশ্বস্থ জনের সম্পর্কটা বেশ মজবুত । প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন অফিস সহকারী বা একজন ছাত্রলীগ নেতার এমন কর্মকা-ে গা শিউরে উঠে । তবে এদের হয়তো শাস্তি হবে । কিন্তু এই সব অপকর্মের পিছনে যারা আছেন তারা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবেন। তাদের হাত অনেক লম্বা । প্রধানমন্ত্রী হয়তো জানেনই না এমন দীর্ঘ হাত ওয়ালারা তাঁর কত প্রস্তাব বা অনুমোদন বদলে দিয়েছেন । কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে এই সব নিয়োগে বড় ধরণের কারসাজি আছে আর তা প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষদের সহায়তায় হয়েছে, তিনি এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ।
ব্যাংক মালিকদের একজন বড় মাপের নেতা । প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন । মাথায় টুপি, সাদা লম্বা দাঁড়ি । বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এটা প্রমাণিত হয়েছে তিনি দুই হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির সাথে জড়িত । তিনি নিজে একটি ব্যাংক, তৈরী পোষাক কারখানা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক । সরকারি জমি দখল করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে । উপরে বর্ণিত দুই ব্যক্তিই এক সময় বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । তাদের একজন সংসদ সদস্যও ছিলেন । বিএনপি’র ভবিষৎ নেই বলে তিনি দল ছেড়ে এই সব নষ্ট কর্মকা-ে যোগ দিয়েছেন । রাতারাতি আওয়ামী লীগ । আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি । যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন তা হলে কি ভাবে এই সব ব্যক্তি এত সব অপকর্ম করে পার পেয়ে যায় ?
করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তদের কোটি কোটি টাকার প্রণোদনা আর সাহায্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সর্বমহলে প্রশংশিত হয়েছেন । এর মধ্যে আবার কিছু তথাকথিত জনপ্রতিনিধি চাল তেল চুরি করে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে । প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ দু’কোটি মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে ঈদের উপহার দেবেন মোবাইলের মাধ্যমে । এক শ্রেণীর ছিঁচকে চোর বাটপার মনে করলেন এই তো সুযোগ । ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর হিসাব অনুযায়ী ষাট লাখ মানুষ এই ত্রাণের জন্য ফোন নম্বর পাঠিয়েছে । তিনি আরো জানান ষোল শতাংশে একই মোবাইল নম্বর একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে । কোন কোন এলাকার চেয়্যারম্যান নিজের নাম প্রথমে দিয়ে পরিবারের আরো চারজনের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন । এই জন্য একই মোবাইলের নম্বর একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে । চারটি মোবাইল হতে ৩০৬ জনের নাম তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে । এই অনাচারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ত্রাণ নিতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে আর মোবাইল নম্বর ভেরিফাই করে টাকা ছাড়া হবে আর তা করবেন জেলা প্রশাসক কোন চেয়্যারম্যান বা মেম্বার নন । এর আগে ৬৪ টি জেলায় চৌষট্টি জন সরকারি আমলাকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে । এর অর্থ দাঁড়ালো এই, শুধু সাধারণ মানুষ নয় সরকারও এই জনপ্রতিনিধিদের উপর আস্থা হারানো শুরু করেছে । তবে তার মধ্যে কিছু জনপ্রতিনিধি আছেন দেশের এই ক্রান্তিকালে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছেন । মাঝে মধ্যে চিন্তা হয় এমন যদি চলতে থাকে শেখ হাসিনার অবর্তমানে দেশটির কি হবে?
লেখক : বিশ্লেষক ও গবষক । ১৮ মে ২০২০