জুয়েল আশরাফ »
এই যে শুনছেন!
আচমকা পেছন থেকে আওয়াজে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে কাইস। সে ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকাল। একটি লম্বা, ফর্সা আর সুন্দরী মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পরনে জিন্সের ওপর গোলাপি রঙের শার্ট। কাঁধ পর্যন্ত চুল কাটা। বামহাতে ঘড়ি। ডানহাতে ব্রেসলেট। কাইসের কাছে একটু অদ্ভুত মনে হলো। কাইস চিনতে না পেরে বলল, মাফ করবেন। আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। মেয়েটিকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। এক কোণায় সোফায় পার্সটা প্রায় ছুড়ে ফেলে দিল সে। নিজেকে এক কোণায় ডুবিয়ে দেওয়ার পরে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে বলল, আমি মানসুরা। আমাকে নতুন নিয়োগ করা হয়েছে। এক মাসের জন্য এখানে আসব। আপনাকে কেউ বলেনি? আপনার নাম কাইস, তাই না? আমাকে আপনার সম্পর্কে বলেছে। আমার যদি কোনো ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তবে আপনার কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে। কাইস কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানসুরা নতুন প্রশ্ন তুলে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কাইস তার আগেই বলল, হ্যাঁ, আমি কাইস। আজ শুক্রবার। তাই খুব কম লোক আসবে। জরুরি কিছু কাজ করতে হবে তাই এসেছি। আপনার যদি কিছু লাগে আমাকে জানাবেন। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্য আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। একথা বলে কাইস চুপ হয়ে গেল। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের কাজের ফাইল খুঁজতে লাগল। এতক্ষণে মেয়েটির ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে আর কাইসকে পূর্ণচোখে দেখছে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার পুরো নাম কী? আপনার নামটি খুব আকর্ষণীয়। এটা আপনার আসল নাম? এমন প্রশ্ন কাইস আশা করেনি। ফাইলগুলো খুঁজতে খুঁজতে একটু থেমে প্রশ্নবোধক চোখে বলল, হ্যাঁ? মেয়েটি তার প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করে বলল, আপনার পুরো নাম কী? কাইস বলল, কাইস। আমার পুরো নাম কাইস।যেন সেই গোলগাল মেয়েটি ছদ্মনামের লেজ ধরেছে। সে বলল, যেমন আমার নাম মানসুরা আহমেদ। ঠিক তেমনই আপনার নামেন একটি উপাধি থাকবে। আজকাল কার একক নাম আছে? আপনার উপাধি কী? এ বিষয়ে কাইস ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হলেও সে তা প্রকাশ না করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, আমার নাম কাইস। সামনে আর পেছনে কিছু নেই। উপাধি নিয়ে কী করবেন? মানুষ হওয়াই যথেষ্ট! এই বিষয়ে কাইস সম্পর্কে অফিসে নতুন মেয়েটির প্রথম মতামত হলো, তাকে অহংকারী দেখাচ্ছে! কাইস যখন ফাইল নিয়ে তার ডেস্কে এসে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকাল, সে বুঝতে পারেনি সে কোথায় পৌঁছেছে। পর্দায় কিছু ছবি ঘুরতে থাকে। তারপর অতীতের কিছু স্মৃতি উল্টাতে শুরু করে। ইচ্ছে করেও মনের যাত্রা থামাতে পারল না। মনে পড়ে, স্কুলে প্রথম দিনগুলোতে তার নাম নিয়ে প্রায়ই উপহাস করতো। তাকে নিয়ে ছাত্ররা গবেষণা করতো। নাম নিয়ে যত না চিন্তিত সবাই আরও বেশি ভাবনায় পড়তো গায়ের রঙের জন্য। তার মুখ সাদামাটা আর সরল। রং গাঢ় কালো। চুল অত্যধিক কালো আর চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। মজার ব্যাপার হলো যে কেউ যখনই তার মুখটা পুরোপুরি দেখার চেষ্টা করে, চোখ তাকে নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু দেখতে দেয় না। তার মুখে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কিছু মানুষ প্রায়ই বলে, কাইসের গায়ের রঙ আর কয়লার রঙ সমান। বাংলাদেশে যদি নিগ্রোর বংশধর থেকে থাকে তা কাইস। নিগ্রো থাকলে কাইস আছে। যদি এই দেশে কালো ছেলে থাকে, সে কাইস। আর একবার ওর দিকে তাকাও, ওর রঙের দিকে তাকাও, অন্ধকার আর কাইসের মধ্যে পার্থক্য কী! হা হা হা। এসব শুনে ছোটবেলা থেকেই কাইসের মনে ক্ষত শুরু হয়। তাকে রং সংক্রান্ত বৈষম্যের আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে। পাড়া-মহল্লায়ও তিরের মতো লেগেছে, রঙের ব্যাপারে, কালুতি, কল্লন, কাককালো, কল্লী মহিষ, কালো অন্ধকারের মতো অনেক জোকস। যাই হোক, এই শব্দগুলো এখন আর তেমন ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু ছোটবেলায় শোনা এসব কথা ক্ষত সারাতে পারে না। শৈশবে খুব কম ক্ষত সেরে যায়। ভরে গেলেও তারা একসঙ্গে থাকে জীবনের চিহ্ন হিসাবে।
কাইস আরও গভীরে চেয়ারে ডুবে চোখ বন্ধ করল। সে ভাবতে থাকল। সে সব মনে রেখেছে। ভাবনার সিকোয়েন্সটা এখন ছবি দিয়ে মাথায় আসছে। সে মনে রেখেছে ক্লাস ফাইভের দুর্ঘটনা। হ্যাঁ, সে এটাকে তার নিজের শৈশবের দুর্ঘটনা বলে মনে করে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আঘাত লেগে রক্ত বের হতে হবে এমন নয়। অনেক দুর্ঘটনা মনকে এমনভাবে আঘাত করে যে সময়ও তাদের প্রতিকার করতে পারে না। খুব সুন্দরী একটা মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তার নাম নিগার। সে এত সুন্দর! তার গায়ের রং উজ্জ্বল। সে দ্রুত সব ছেলেদের মধ্যে আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠল। আশ্চর্যের বিষয় হলো স্যার যতক্ষণ ক্লাসে থাকেন ততক্ষণ পরিবেশটা ভালোই থাকে। কিন্তু তার চলে যাওয়ার পর সবাই নিগারের থেকে দূরে সরে যায়। ছেলেরাও নিগারের সঙ্গ পছন্দ করে না। একটি কারণ ছিল কাইসের প্রতি স্যারের অতিরিক্ত মনোযোগ, যা সবার মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দিল। সবাই অনুভব করল যে, তাদের প্রতি স্যারের ভালোবাসা কমে গেছে। স্যার নিগারকে কাইসের সঙ্গে বসিয়ে দেন। নিগার কাইসের সঙ্গে কম কথা বলতে পছন্দ করতো। একবার কাইস ক্লাস ফাইটে নিগারের পক্ষ নিল, যার কারণে নিগারের মনে কাইসের প্রতি বন্ধুত্বের প্রথম অনুভূতি জাগ্রত হয়। কিছুদিন পর নিগারের সঙ্গে কাইসের সম্পর্ক ভালো হতে থাকে। একবার নিগারের মা কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করতে স্কুলে আসেন। সেদিন নিগার উত্তেজিতভাবে কাইসকে তার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, মা এটা আমার বন্ধু। কাইস! তোমাকে বলিনি!
মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কাইস একটু নার্ভাস বোধ করল। কারণ তার মা কাইসের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। এবং তিনি কিছু বলছেন না। নিগারের সঙ্গে কাইসের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে। নিগার কাইসের থেকে কপি আনতে অনেকবার বাড়িতে আসতো বা ঠিক এ রকমই। কাইসের মা তাকে খুব ভালোবাসতেন। নিগারকে বিশেষ কিছু বানিয়ে খাওয়াতেন। নিগার খুব পছন্দ করেছে। যখন সে আসতো, কয়েক ঘন্টা বসে থাকতো আর পরের দিন বলতো, তার মা তাকে অনেক বকাঝকা করেছে। নিগার কায়েসের প্রতি এতটাই আসক্ত ছিল যে সে কিছু লুকিয়ে আর চাপা না দিয়ে কথা বলতো।
গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়ে গেল। তারা দুজনেই এবার একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিল নিজেদের নতুন খেলা আবিষ্কার করবে আর স্কুলে দেওয়া কাজ একসঙ্গে করবে। এভাবেই দিন কাটছিল। যখনই নিগার কাইসকে তার বাড়িতে আসতে বলতো, তখনই নিগারের মাকে নিয়ে কাইসের মনে ভয় থাকত। কিন্তু এই ভয়ের কথা সে কখনই নিগারকে জানায়নি। কিছুদিন পর। নিগারের বাড়িতে বাড়ি মেরামতের কাজ হয়। তখন নিগার জোর দিল যে, এক বিকালে কাইসকে তার বাড়িতে খেলতে আমন্ত্রণ জানানোর। সেই গরম বিকালে কাইস পৌঁছে গেল তার বাড়িতে। কাইস তার মায়ের সেলাই করা গোলাপী রঙের শার্ট পরেছে। চুল ছোট, তাই কপালে আসেনি, চুল ঠিক করেছে। তার কপালে কোনো দাগ ছিল। রং কালো হলেও কাইস দেখতে খুব সুন্দর।দুজনই বাড়ির খুব বড় ছাদে কেরাম খেলতে লাগল। নিগার সেদিন তাকে তার নামের কারণ জিজ্ঞেস করেছে। তারপর কাইস হেসে বলল, বাবা একটা বই পড়েছেন। বইতে একটি নাম খুব পছন্দ হয়েছে। ভাবলেন ছেলে হলে তিনি নাম রাখবেন কাইস। আমি যখন জন্মেছিলাম তখন বাবা নামটি রেখেছিলেন। কাইস আরও বলল, সবাই আমার নামটি অদ্ভুত মনে করে। জানি না কেন! তোমারও কি তাই মনে হয়? নিগার বলল, না! আমার খুব ভালো লাগে। আমার বাবাও তোমার নাম খুব পছন্দ করেন। রাতে কাজ থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করেন, তোমার বন্ধু কাইস কেমন আছে?
দুজনই এসব নিয়ে মগ্ন। এমন সময় নিচ থেকে মায়ের জোর আওয়াজ ভেসে এলো। নিগার তড়িঘড়ি করে কাইসের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। সিঁড়ি থেকে নিজেই বলে উঠল, মা দেখো কে এসেছে? দেখো দেখো, কাইস এসেছে! নিগারের মায়ের অনেক জেদ এসে গেল। তিনি বললেন, তুমি কাইসের সঙ্গে মেশো কেন? সে কতো বিশ্রী ধরনের কালো, মনে হচ্ছে সে নোংরা। তার সঙ্গে কথা বলবে না।
নিগার বলল, কিন্তু মা কাইস আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। জানো সে আমাকে কতটা সাহায্য করে? যখন ক্লাসে ঝগড়া হয়, সে আমার সঙ্গে থাকে। নিগারকে তার মা দ্রুত শুধরে দিয়ে বললেন, এসো ছেলে বসো! নিগার তোমাকে কিছু খাইয়েছে?
নিগারের কথা তার মাকে একটু বিচলিত করেছে। সেই সময় কাইসের সঙ্গে চোখের যোগাযোগ করাও তার কঠিন। কাইস তার দিকে তাকিয়েছিল। কাইস যা-ই শুনেছে, এখন পর্যন্ত তা তার ভেতরে ঢুকে গেছে। নিগারের মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করা উচিত বলে তার মনে হলো। এত কাঁদবে যে তার মায়ের কান যেন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সে কিছু বলল না। চোখে পানি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল। নিগারের কণ্ঠ তাকে ডাকতে থাকল পেছনে। কিন্তু কাইস নিগারকে তার কণ্ঠস্বর, তার বন্ধুত্ব, তার নিষ্পাপ মন আর তার মাকে পেছনে ফেলে চলে গেল। সে ফিরে তাকায়নি। সেদিন অপমান সহ্য করে সে নিগারের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু একটা ক্ষত এসে গেল। মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা দ্বৈততা বোঝা গেল ওই বয়সে। বাড়ি ফিরে মায়ের মেকআপ বক্সে ফেয়ারনেস ক্রিম খুঁজলেও তেমন কোনো ক্রিম খুঁজে পেল না। মা বাড়ি ফিরে ছেলেকে অসহায় ও মন খারাপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। মাকে কাইস জিজ্ঞেস করল, ফেয়ারনেস ক্রিম রাখো না মা?
মা কিছু বললেন না। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলেন। মা যতটা পেরেছেন ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন কোরআনের লেখা কালো। যাদের গায়ের রং কালো তারাই স্রষ্টার সবচেয়ে কাছের।
স্কুলের পর কলেজে এ রকম ছোটখাটো ঘটনা ঘটতে থাকে। কেউ নানাভাবে ক্রিম লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে, আবার কেউ বলেছে ঘরে ফেসপ্যাক লাগাতে। বহুদিন পর্যন্ত সে এটা বিশ্বাস করেছিল।
কাইস যে বিভিন্ন পদক্ষেপে চেষ্টা করেনি তা নয়। সে এটি চেষ্টা করে আর পরে তাদের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। এর পেছনে কলেজের এক স্যারের মতামত পাওয়া গেছে। সেই স্যার তার ভেতরের পরিষ্কার রঙের খড় বের করে এমন মূল্যবান কিছু ভরে দিলেন যে কাইসের ভালো পরিবর্তন হলো।
কাইস চেয়ারের পেছনে মাথা রাখল। সেইদিনটির কথা মনে পড়ল যেদিন সে সত্যিই স্যারের সঙ্গে দেখা করেছিল। ভাবতে লাগলো, কলেজে পরীক্ষার দিন চলছে। প্রথম পরীক্ষার পর স্যাররা ক্লাসে কাগজের নম্বর দেখাচ্ছিলেন। কাইস এখন পর্যন্ত দেখানো সমস্ত বিষয়ে প্রত্যাশিত নম্বরের চেয়ে ভালো পেয়েছে। শুধু ইতিহাসের শিক্ষক, যিনি অসুস্থ, তিনি পেপার পরীক্ষা করতে পারেননি। সেদিন হঠাৎ ক্লাসে এলে তাকে আগের থেকে অনেক ভালো লাগছিল। যেহেতু তিনি ইতিহাসের একজন নতুন শিক্ষক ছিলেন, তাই তিনি ছাত্রদের মুখ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন না। স্যার এসেই ক্লাসে বললেন, কাইস কে? প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ জন ছাত্রের ক্লাসে কাইস নাম নিয়ে বচসা শুরু হয়। নাম শুনে কেউ কেউ আবার হাসতে শুরু করে। কিছু অদ্ভুত মুখ করা শুরু। কাইস আতঙ্কে সিট থেকে উঠে বলল, আমার নাম।
ইতিহাসের পেপার বের করে স্যার বললেন, আমি আমার পঁচিশ বছরের ক্যারিয়ারে এমন ইতিহাসের পেপার দেখিনি। স্টুডেন্টস ইতিহাসকে বিরক্তিকর মনে করে আর তারিখ মুখস্থ করে ভুল উত্তর লিখে। কিন্তু তোমার কাগজ পরীক্ষা করে দেখা গেল বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তারিখের অর্থও জানা আছে। তোমার তিরানব্বই নম্বর এসে গেছে। আমি অনেক কঠিন মার্কিং চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি অনুভব করেছি তুমি এমন ফাঁক রাখোনি।
কাইস কেবল মাথা নাড়ল। তিরানব্বই নম্বরটি কাইসের মনে ঘুরতে থাকে। সে এত খুশি যে তার মুখ থেকে কথা বের হলো না। স্যার কাছাকাছি ডেকে তার হাতে কাগজ দিতে গিয়ে বললেন, ভবিষ্যতেও তাই প্রত্যাশিত। তোমার খুব মিষ্টি নাম ও চেহারাও।
এই দৃশ্য হঠাৎ কাইসের জন্য ক্লাসে করতালির সৃষ্টি করে। ক্লাস শেষ হলে স্যার কাইসকে তার সঙ্গে যেতে বলেন।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কে নাম রেখেছে?
কাইস বলল, বাবা।
তোমার নামটি খুব সুন্দর। তোমার সঙ্গে মিলে যায়।
অনুরূপ সংখ্যা পাশাপাশি পরবর্তী কাগজে উপস্থিত হওয়া উচিত। কাইস মাথা নাড়ল উপরে-নিচে। পরবর্তী দিনগুলোতে, সেই স্যার কাইসের ভেতরে অনেক ভালো পরিবর্তন আনতে সাহায্য করলেন। আজও কাইস যায় তার সঙ্গে দেখা করতে। বসে গল্প করে। স্যারের কাছে নিজেকে হালকা অনুভব করে।
চেয়ারে বসে কাইস এসব স্মৃতিতে ঘোরাফেরা করছে।
পেছন থেকে মানসুরা টেবিলে চায়ের কাপ রেখে বলল, কাইস সাহেব, কাইস সাহেব, চা খান। ঘুম চলে যাবে।
আমি নিজের জন্য তৈরি করছিলাম। ভাবলাম, আপনার জন্যও এক কাপ করা উচিত। এই বলে মেয়েটি মোবাইল নিয়ে এসে কাইসের কাছে বসে গান বাজানো শুরু করে জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, পাছে ভালোবেসে ফেলো তাই …।
মেয়েটি বলল, শুধু ডাউনলোড করেছি, আপনার জন্য।
তার ইশারা দেখে না হেসে থাকতে পারল না কাইস। সে হেসে বলল, চায়ের জন্য ধন্যবাদ। মানসুরা এখন সম্ভবত আবার তার নামের পেছনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু কাইস অবাক হয়ে গেল। সে গান শুনে মগ্ন হয়ে চায়ে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় মানসুরা কোমল গলায় বলল, ঠিক পনেরো বছর আগে আমার স্কুলের একটি ছেলেকে বাড়ি এনেছিলাম, আমার মায়ের সে কী রাগ!
ছেলেটি অসম্ভব কালো বলেই আমার মায়ের আচরণে কষ্ট পেয়ে আমাদের বাড়ি থেকে সেই যে সে বেরিয়ে গেল, আর তার দেখা পাইনি। অনেক খুঁজেছি তাকে। প্রতি বছরই খুঁজি। কত লোকদের বললাম খুঁজে দিতে। আপনাকেও বলে রাখলাম কালো মানুষটাকে খুঁজে দেবেন। এক মিনিট দাঁড়ান মানুষটার ছবি দেখাই আপনাকে।
বলতে বলতেই মানসুরা নিজের পার্স থেকে ছোট্ট একটা আয়না বের করে কায়েসের মুখের সামনে মেলে ধরল।
অপরিচ্ছন্ন আয়নার ভেতর থেকেও কায়েস পরিষ্কার দেখল মানসুরার চোখ ভিজে গেছে। এখনই গাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে যাবে বুঝি। এই মুহূর্তে কায়েস খুবই কষ্ট পাচ্ছে, আজ এত বছর পর নিগারকে চিনতে না পারার কষ্ট।