পানি স্বল্পতার ‘ধাক্কা’
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙামাটি :
মৌসুমের শুরুতেই রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতার কারণে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, সেটির ধাক্কা লেগেছে মাছ আহরণে। যার প্রভাবে বিগত মৌসুমের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি মৌসুমের প্রথম চার মাসে অবতরণ কমেছে ৮৮০ টন। মাছ আহরণ হ্রাসের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিগত কয়েক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণের যে রেকর্ড ছিল, সেই রেকর্ড এবার ধাক্কা খাবে- এমনটাই বলছে বিএফডিসি।
জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদে মাছ কমে যাওয়ার কারণে জেলেরা জাল ফেলেও আশানুরূপ মাছ পাচ্ছেন না। একদিকে জেলেরা নিজেদের পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া দাদনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অন্যদিকে আহরণ হ্রাসের পাশাপাশি করোনার ‘অজুহাতে’ বাজারে মাছের মূল্য আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। যে কারণে আহরণ হ্রাস ও বর্তমান বাজার মূল্যের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খাতনির্ভর সকলেই। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ মৌসুমে পহেলা আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের আওতাধীন রাঙামাটি, কাপ্তাই, মারিশ্যা ও মহালছড়ি- এ চারটি বিপণন কেন্দ্রে ৪ হাজার ৩৯৫ টন মাছ অবতরণ করা হয়।
চলতি ২০২০-২১ মৌসুমের পহেলা আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চারটি বিপণনকেন্দ্রে ৩ হাজার ৫১৫ টন মাছ অবতরণ করা হয়। যা বিগত মৌসুমের চেয়ে ৮৮০ টন কম। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে প্রথম মাস আগস্টে বিগত মৌসুমের চেয়ে আহরণ বেড়েছিল ৩৯০ টন। কিন্তু নভেম্বরে এসে আহরণ হ্রাস পেয়েছে। আবার আহরিত মাছের মধ্যে ছোট মাছের পরিমাণ বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম জানান, চলতি মৎস্য মৌসুমে আমরা কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতার কারণে ১০ আগস্ট আহরণ শুরু করছি। হ্রদের পানি কম থাকলেও আমরা জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনা করে আহরণ শুরু করেছি। কিন্তু এতে যে সংকটটি দেখা দিল, তা হলো পানি স্বল্পতার কারণে হ্রদে প্রাকৃতিক প্রজনন করা মাছসহ বিএফডিসির অবমুক্ত পোনামাছগুলো হ্রদের ছোট-ছোট ঘোনাগুলোতে ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারেনি। এছাড়া আহরণ শুরুর পর পানি স্বল্পতার কারণে জেলেদের জালে ছোট-বড় এসব মাছ অতিমাত্রায় ধরা পড়েছে। যে কারণে পরবর্তীতে হ্রদে ভরপুর পানি হলেও এই সময়টাতে এসে আমাদের আহরণ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী, সামনে যে কয়েকটা মাস আছে সেগুলোতে আহরণ বাড়বে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের মাছ আহরণের ধারাবাহিক রেকর্ডে এবার ধাক্কা লাগতে পারে।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়ুয়া বলেন, প্রথমদিকে পানি স্বল্পতার কারণে যখন অতিমাত্রায় মাছ আহরণ হয়েছে, তখনই আমরা এই শঙ্কায় ছিলাম। এখন সেটি বাস্তবে রূপ নিলো। বিগত মৌসুমের চেয়ে এ বছর হ্রদের মাছ অনেক কমে যাওয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে পরিমাণ মাছ বাজারজাতকরণ করা হতো তা এবার কমে গেছে। আবার যে সকল জেলে মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছেন তারাও আশানুরূপভাবে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সঠিক সাইজের মাছ না পাওয়া, বাজারমূল্য হ্রাসের কারণে জেলে-ব্যবসায়ী আমরা সবাই এবার অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।
বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের মার্কেটিং অফিসার বৃন্দাবন হালদার জানান, বিগত মৌসুমগুলোতে হ্রদে মাছের আহরণ অন্য মৌসুমের চেয়ে বাড়লেও এবার তা হচ্ছে না। গত চার মাসের হিসাব বলছে, আমাদের চার মাসে মাছ অবতরণ হ্রাস পেয়েছে ৮৮০ টন। একই সঙ্গে কমেছে রাজস্ব আদায়ও। এটি বিএফডিসিসহ খাত সংশ্লিষ্ট সকলের বড় ধরনের ক্ষতি।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়গুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। কাপ্তাই হ্রদের আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর, যা বাংলাদেশের পুকুরগুলোর মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের বংশ বৃদ্ধি, হ্রদে অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষম বৃদ্ধি, মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করাসহ হ্রদের বাস্তুতন্ত্র অক্ষত রাখতে প্রতি বছরের ১ মে থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বছরের আগস্টে শুরু হয় নতুন মৌসুম। পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চলে আহরণ। আর এ নয় মাসকে মৌসুম ধরা হয়।