ঘরমুখো মানুষ মরিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক >
ভোর ৫টা। নুরুল আমিন জামালখানের বাসা থেকে বেরিয়েছে বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। গন্তব্য নোয়াখালী বেগমগঞ্জ। জামালখান রোড থেকে তিনি সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে গিয়েছেন একে খান মোড়ে। এতে দাঁড়ানো ছিল বেশ কয়েকটি মিনি বাস। এসব গাড়ি জনসম্মুখে ডাকছেন যাত্রী। ফেনী মহিপাল সরাসরি ভাড়া তিনশো। এতে উঠে পড়েন এ গাড়িতে। কিন্তু জুড়ে দেওয়া হয়েছে শর্ত। পুলিশের চেকপোস্টে বলতে হবে গন্তব্য বারৈয়ারহাট। এমন শর্তে রওনা হলো ফেনীর উদ্দেশ্যে।
সিটি গেট যেতেই পুলিশের বাঁধা। চলছে তল্লাশি। গাড়ি কোথায় যাবে জানতে চাইলে চালক জানান বারৈয়ারহাট। ছেড়ে দেওয়া হলো গাড়ি। পুলিশকে বলা মতে ঠিক বারৈয়ারহাট এসে নামিয়ে দিল গাড়ি। কারণ ওপাড়ের জন্য রয়েছে অন্য গাড়ি। তুলে দেওয়া হলো অপর গাড়িতে। সে গাড়িতে চড়ে নামানো হলো মহিপাল ফেনী। এতেও ছিল পুলিশি বাঁধা। কোন গাড়ি দাঁড়াতে দিচ্ছিলেন না। প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরে সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে এ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হলো নোয়াখালী চৌমুহনির উদ্দেশ্যে। এতে ভাড়া নেওয়া হয় ১শ’ থেকে ১২০ টাকা। সোনাপুরের দিকে গেলে আড়াইশ টাকার কম নয়। তিনি এমন অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সুপ্রভাত বাংলাদেশকে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ও ঈদে ঘরমুখী মানুষের চাপ কমাতে ৫ মে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এতে জানানো হয়, ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে লকডাউন। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলার অভ্যন্তরে চালানো যাবে পরিবহন। তবে দূরপাল্লার গাড়ি, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ঈদের ছুটিতে সরকারি বেসরকারি চাকুরিজীবীদের থাকতে হবে স্ব স্ব কর্মস্থলে। ঈদের ছুটিতেও থাকবে লকডাউন। যা গত বছরেও দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু এসব নির্দেশনা মনছে না মানুষ। বাড়ি যেতে ভিড় করছে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসে। কিন্তু এবারের ঈদ অন্যান্য বারের চেয়ে একটু ভিন্ন। নেই দূরপাল্লার পরিবহন! ফলে অনেকটা কাঠখর পুড়িয়ে যেতে হচ্ছে নিজ গন্তব্যে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর বাস টার্মিনাল অলংকার ও একেখান মোড়ে ঘরমুখী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কদমতলী থেকে বারৈয়াহাট পর্যন্ত ছেড়ে যাওয়া উত্তর ও গরিবুল্লা শাহ চয়েস যেন একমাত্র ভরসা। জেলার অভ্যন্তরে চলাচলরত বাসে চড়ে মানুষ পার হচ্ছে সিটি গেট। আবার কিছু মানুষ ছোট ছোট ব্যাগ হাতে হাঁটছে। সিটি গেট পার হতে পারলেই মিলবে তাদের মুক্তি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ এলাকা পার হলে আছে ছোট ছোট সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও টেম্পুর ব্যবস্থা। তাছাড়া ঘরমুখী মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে পড়ছে ট্রাকে। ট্রাক দাঁড়ালেই মানুষের ঢল। উঠতে চায় সকলে। কিন্তু কারো জায়গা হলে কেউ উঠতে অসক্ষম। তারপরও চেষ্টার কমতি নেই। এতে সামিল করেছে ছোট ছোট শিশুদেরও। নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে তো ফেলছেই তার ওপর নষ্ট করছে ভবিষ্যত প্রজন্ম। এ গাড়ি চড়ে যাওয়া যেটুকু পথ যাওয়া যায় তাতেই গন্তব্য ফুরাবে। তবে বারৈয়ার হাট বা সীতাকুণ্ড পৌঁছাতে পারলেই মিলবে বিভিন্ন গন্তব্যের গাড়ি। এ যেন বাড়ি ফেরা মানুষের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কে আগে গাড়িতে উঠতে পারে এমন প্রতিযোগিতায় অনেকে সম্মুখীন হচ্ছেন দুর্ঘটনার। তাছাড়া প্রতি ঈদে এমন সময়ে স্বজন হারানোর কান্নার ভারি হয়ে উঠে দেশ।
অন্যদিকে বাস আসতেই হুমরে পড়ছে যাত্রী। সুযোগ পেয়ে এসব পরিবহন দ্বিগুণ হারে ভাড়া বৃৃদ্ধি করে রেখেছে। তারা মানুষের মন বুঝতে পেরেছে। নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতেই হবে কর্মস্থল ছেড়ে বেরিয়ে পড়া মানুষের। তারা পিছপা হওয়ার নয়। ভাড়া যতই হোক ফিরতে হবে বাড়ি। এ সুযোগ বুঝে অনেকে মিনি ট্রাক নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে বেড়িয়ে পড়েছে গাড়ি নিয়ে। অন্যদিকে শাহ আমানত সেতু এলাকায় দেখা মিলে একই চিত্রের।
তাছাড়া রাত হলে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বাস। নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরী ঘাট পর্যন্ত ২শ’ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬শ’ টাকা। তাতে ও কোন সিট খালি থাকছে না।
বরিশাল যাওয়া পথে রায়হান নামে এক পোশাক শ্রমিক বলেন, ‘সারা বছর গার্মেন্টসে হাজার শ্রমিক একসাথে কাজ করেছি। এতে করোন হয়নি। এখন বাড়িতে গেলে করোনা হবে? বছরে একবারই ঈদে বাড়ি যাই। এ সময়েও যদি এমন কষ্ট করা লাগে আমাদের জীবনটা বৃথা হয়ে গেছে।’
অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে বলে দাবি করে যাত্রী কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সাধারণ সময়ে চট্টগ্রাম বারৈয়াহাট রোডে চলাচলকারী উত্তরা ও চয়েস পরিবহনগুলোতে সর্বোচ্চ ভাড়া ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে গণপরিবহনগুলো।
অন্য এক যাত্রী নাজিফা বলেন, ‘দুই বছর পরে মা বাবা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ঈদ শেষে একা চট্টগ্রামে আসবো। এ শহরে পরিবার নিয়ে থাকা অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। তাই তাদের বাড়িতে রেখে আসবো। মালপত্র কিছু নিচ্ছি না তারপরও মালপত্রসহ বাড়ি যাওয়ার খরচে নিজেরা যাচ্ছি।’
বাড়তি ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরা পরিবহনের চালক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতি সিটে একজন করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। এতে করে প্রতি সিরিয়াল প্রতি বেতন উঠাতে কষ্ট হয়ে যায়।’
সিটি গেট এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘নগর থেকে যেন জনমুখি স্রোত বের হচ্ছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। যে যেভাবে পারছে ছাড়ছে নগর। এই জনমুখী স্রোত ঠেকাতে সিএমপি পশ্চিম ট্রাফিক বিভাগ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অধিক যাত্রী পরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়িতে যাত্রী পরিবহন ও নানা সরকারি নির্দেশনা অমান্যর অপরাধে মামলা চলমান থাকলে ও অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পশ্চিম ট্রাফিক বিভাগের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কোন ব্যক্তিগত গণপরিবহন যাতে যাত্রী নিয়ে চেকপোস্ট পার হতে না পারে। যেহেতু সিটি গেট দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যাতায়াত করে তাই ঘরমুখো জনস্রোত ঠেকানোর চেষ্টা করছি। সিটি গেটের বাইরে যে সকল যানবাহন যাত্রী পরিবহন করছে তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এরপরেও বিভিন্ন পথে সিটি গেট পার হয়ে তারা যাত্রী পরিবহন করছে। এর ফলে গত ৩ দিনে ৩৯০টি গাড়ি আটক করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পশ্চিম বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ‘ব্যক্তি মালিকানাধীন যে সকল পরিবহন ঈদ কাটাতে পরিবার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে সে সকল গাড়িকে চেকপোস্টে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার ব্যক্তিগত গাড়িতে যদি যাত্রী বোঝাই করে সেক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে চট্টগ্রাম নগরীতে বিভিন্ন জেলার মানুষ পেশাজনিত কারণে থাকে। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় আন্তঃজেলা যে পরিবহনগুলো চলছে তাতে করেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।’