শিক্ষার্থী হারিয়ে ব্যবসায় ধস, প্রাইভেট
কলেজগুলো বন্ধ হচ্ছে একের পর এক
বন্ধ হলে গেল মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজ, কর্ণফুলী পাবলিক কলেজ, বিএস পাবলিক কলেজ, একই পথে আরো ১০ কলেজ
১০ এর কম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া কলেজগুলোকে শিক্ষাবোর্ডের নোটিশ
ভূঁইয়া নজরুল :
চট্টগ্রাম কলেজের পূর্ব গেইট এলাকায় ২০১০ সালে গড়ে তোলা হয় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজ’। এই কলেজটি গত তিন-চার বছর ধরে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি নিচ্ছে না। অর্থাৎ বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। গতকাল বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেট্রোপলিটন ছাত্রী নিবাস চালু করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।
এই চিত্র শুধু মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজের নয়, একইসময়ে গড়ে তোলা কর্ণফুলী পাবলিক কলেজ ও বিএস পাবলিক কলেজও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সিটি বিজ্ঞান কলেজ, মেরন সান কলেজ, ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ, চট্টগ্রাম পাবলিক কলেজসহ অনেক কলেজ গড়ে ১০ জনের কম শিক্ষার্থী নিয়ে পাঠ কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে।
গতকাল বিকেলে মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজের খোঁজ নিতে চট্টগ্রাম কলেজ পূর্ব গেইট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কলেজটি প্রথমে যে ভবনে কার্যক্রম শুরু করেছিল এখন আর সেই ভবনে নেই। কলেজের কোনো সাইনবোর্ডও নেই। স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তিন চার বছর আগেই কলেজটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মেট্রোপলিটন ছাত্রী নিবাস নামে পাশের একটি তিনতলা ভবন রয়েছে।’ ভবনটিতে ছাত্রী নিবাসের ব্যানারও রয়েছে।
কর্ণফুলী পাবলিক কলেজের খোঁজ নিতে চকবাজার ধুনিরপুলে গিয়ে দেখা যায়, একটি বহুতল ভবনে কলেজের সাইনবোর্ড রয়েছে কিন্তু পুরো ফ্লোরটি ফাঁকা এবং তালাবদ্ধ।
একইভাবে চকবাজার গুলজার মোড়ের পাশে চট্টগ্রাম ল্যাবরেটরি কলেজের পাশে চালু হয়েছিল ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বিএস পাবলিক কলেজ। সেই ভবনটির নিচে এখন লাইব্রেরি দেখা যায়। অপরদিকে সিটি বিজ্ঞান কলেজ নামের কলেজটি কোতোয়ালী মোড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, মতি টাওয়ার হয়ে এখন গুলজার মোড়ে ল্যাবরেটরি কলেজের বিপরীত পাশে রয়েছে। সেখানেও এবার ১০ জনের কম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।
প্রাইভেট কলেজগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন?
একসময় চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ, সাউথ এশিয়ান কলেজ, মেট্রোপলিটন সায়েন্স কলেজ, মেরন সান কলেজ, মেরিট বাংলাদেশ কলেজ, সেন্ট্রাল পাবলিক কলেজ, কর্ণফুলী পাবলিক কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের নামে পত্রিকাগুলোতে ভর্তি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। কিন্তু এখন আর সেই জোয়ার নেই। কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। এই দুরাবস্থার কারণ জানতে চাইলে বিএস পাবলিক কলেজের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আজিজ বলেন, ‘সরকারি কলেজের পাশাপাশি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন বাড়ানোর কারণে আমাদের মতো প্রাইভেট কলেজগুলো শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। তাই আর্থিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আমাদেরকে সরে আসতে হচ্ছে।’
একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ, সিটি বিজ্ঞান কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জাহেদ। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থী না পেলে কোনোভাবেই শিক্ষক ও স্টাফদের বেতন অব্যাহত রেখে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমনও অনেক এমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে যাদের আগে ৩০০ আসন ছিল এখন ৯০০ করা হয়েছে।’
আসন বাড়ানোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নয়, সরকারি কলেজগুলোতেও আসন বাড়ানো হয়েছে। সরকারি কলেজে আসন বাড়ানোর কারণে চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষার্থী কম টাকায় সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে।
একসময় নগরীতে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, সিটি কলেজ ও সরকারি মহিলা কলেজ ছাড়া অন্য কোনো কলেজ না থাকলেও এখন কয়েকটি কলেজ সরকারিকরণ হয়েছে। এগুলো হলো- বাকলিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম মডেল কলেজ ও কলেজিয়েট স্কুল।
এবিষয়ে কথা হয় সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অঞ্জন নন্দীর সাথে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীক মনোভাব নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে তা টিকে রাখা কঠিন। ২০১০ সালের দিকে অনেক প্রাইভেট কলেজ গড়ে উঠেছিল কিন্তু এসব কলেজে শিক্ষক, ল্যাবরেটরিসহ পর্যাপ্ত জনবল কী ছিল? শুধু চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এসব প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিও হাতের নাগালে রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠা প্রাইভেট কলেজগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।’
আসন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজে গত তিন-চার বছরে তিন (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাগে গড়ে ৩০০ আসন বেড়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা লাভবান হচ্ছে। একইভাবে অন্যান্য সরকারি কলেজগুলোতেও আসন বাড়ছে প্রতিবছর।’
শিক্ষাবোর্ডের বক্তব্য
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য নিয়ে এসব কলেজ গড়ে উঠেছিল। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি বলে কলেজগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে অনলাইন ভর্তি পদ্ধতির কারণে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো সম্ভব নয়। সেইসাথে শিক্ষাবোর্ডের নজরদারি ছিল। সব মিলিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠা এসব প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এলার্মিং ছিল। আমরা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।’
এবিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর মোহাম্মদ জাহেদুল হক বলেন, ‘চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের সুবিধা দিতে সরকারি কলেজগুলোতে আসন বাড়ানো হয়েছে। কারণ সরকারি কলেজগুলোতে অবকাঠামো সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনিভাবে দক্ষ শিক্ষকও রয়েছেন। অপরদিকে এমপিওভুক্ত নামি কলেজগুলোর মধ্যে যাদের সামর্থ্য রয়েছে আমরা তাদের আসন বাড়িয়েছি, অন্যদের নয়।’
প্রাইভেট কলেজগুলোর উদ্যোক্তাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী পাবলিক কলেজ ও বিএস পাবলিক কলেজ আমাদের কাছে আবেদন করে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছে। এছাড়া অনেকগুলো কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ জনের নিচে নেমেছে। এই কলেজগুলোতে টিউশন ফি বেশি এবং অনেক কলেজে পর্যাপ্ত জনবলও নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না। বিপরীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত কলেজগুলোতে দক্ষ শিক্ষক যেমন রয়েছে তেমনিভাবে একটি মনিটরিং সিস্টেম রয়েছে। সেখানে টিউশন ফিও কম। তাই শিক্ষার্থীরা এখন এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে। আসন বাড়ানোর কারণে প্রাইভেট কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী কমছে অভিযোগটি যথাযথ নয়।’
যেসব কলেজে ১০ বা এর কম শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী সপ্তাহে কলেজগুলোর চূড়ান্ত শিক্ষার্থী তালিকা পেয়ে যাব। আর যেসব কলেজে ১০ বা এর চেয়ে কম শিক্ষার্থী রয়েছে সেসব কলেজগুলোকে নোটিশ করা হবে। কলেজ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কলেজগুলো পরিদর্শন করবো। কীভাবে এসব কলেজকে উন্নত করা যায় সেই সুযোগও দেয়া হবে।’
এবিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘১০ জনের নিচে শিক্ষার্থী এমন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অন্য কলেজে স্থানান্তর করে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধও করে দিতে পারি।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ২৭১টি কলেজ রয়েছে। এসব কলেজের মধ্যে সরকারি কলেজ রয়েছে ৫৫টি। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান ১১৪টি, একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রয়েছে ২০টি এবং পাঠদানের অনুমতি রয়েছে ৮২টি প্রতিষ্ঠানের।