সুপ্রভাত ডেস্ক »
করোনার সংক্রমণ রোধে অনুষ্ঠান-সমাবেশ বন্ধসহ ১১ দফা নির্দেশনা দেশের মানুষকে মেনে চলার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, একটা জিনিস সবাই লক্ষ্য রাখবেন। নতুন ভ্যারিয়েন্ট (ওমিক্রন) দেখা দিয়েছে। এটা খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। এক একটা পরিবারসহ আক্রান্ত হচ্ছে। সবাইকে বলবো, স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে। আমরা ইতোমধ্যে কিছু নির্দেশনা দিয়েছি, সেটা সবাই মেনে চলবেন। সেটাই আমি চাই।’
বৃহস্পতিবার নবনির্মিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমপ্লেক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
সরকার প্রধান বলেন, আর যারা টিকা নেননি, তারা দ্রুত টিকা নিয়ে নেবেন। আমরা স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেওয়া শুরু করেছি। টিকা নিলে অন্তত জীবনে বেঁচে থাকা যায়। বিষয়টি অনুধাবনে সবাইকে অনুরোধ জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্য দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। বিদ্যুৎ আমরা শতভাগ পৌঁছে দিয়েছি মানুষের ঘরে ঘরে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন আমরা করে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছি। এখন আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন উন্নত জীবন পায়, তার পদক্ষেপ নিয়ে প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও তৈরি করে দিয়ে গেলাম। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ করে দিয়েছি। যেন এই ব-দ্বীপটা আগামী দিনে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা সুন্দর জীবন পায়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২১ বছর পরে আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম দেখলাম স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। কমার্স ও আর্টস পড়ে কিন্তু বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁকটা কম, পড়ার আগ্রহটা কম। তখন আমরা ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সেই প্রকল্প আমরাই গ্রহণ করি। সেই সঙ্গে আইন পাস করে ৬টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু করি।
বিজ্ঞান শিক্ষার অনাগ্রহ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পরে যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকারে এসেছিল, তাদের এই অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য তারা সব থেকে বেশি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। একটা এলিট শ্রেণি তৈরি করে। তাদের নানাভাবে অর্থশালী ও সম্পদশালী তৈরি করে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র ও অর্থ তুলে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল। সেখানে রাষ্ট্র কিংবা সাধারণ জনগণের কি প্রয়োজন তাতে তাদের খেয়াল ছিল না। ক্ষমতাকে ভোগ ও কুক্ষিগত রাখাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।
১৯৯১ সালে বিনামূল্যে আন্তর্জাতিকভাবে দেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তখন আমাদের এই অঞ্চলে সাবমেরিন ক্যাবল আসে, বাংলাদেশেকে অফার দেওয়া হয়েছিল বিনামূল্যে যুক্ত হওয়ার জন্য। এটা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ওয়েস্টার্ন ইউরোপ অর্থাৎ সিমিইউ সংযোগ দেওয়ার সুযোগ আসে। আমাদের দুর্ভাগ্য, তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। সে বলে দিলো এটা করা যাবে না, এটা করলে বাংলাদেশের সব তথ্য বিদেশে চলে যাবে।
১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় উন্নতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময় কম্পিউটার কেনার জন্য নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলাম। সেটার অর্ধেক দাম আমরা দিবো, বাকি অর্ধেক তারা দিবে। একটাই শর্ত ছিল এগুলো তাদের দেশ ও কোম্পানি থেকে কিনতে হবে। আমরা তাতে রাজি হয়ে যাই। কারণ, সেটা আমাদের জন্য ভালো প্রস্তাব ছিল। সেক্ষেত্রে আমরা সব পদক্ষেপ গ্রহণ করি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল হচ্ছে টিউলিপ। সেই নামই কোম্পানিটার ছিল।
তিনি বলেন, আমাদের অতি জ্ঞানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কেউ বোঝায় শেখ রেহানার মেয়ের নাম টিউলিপ। নেদারল্যান্ডসের কোম্পানিটাও তার। তাই ওখান থেকে তা নেওয়া যাবে না। তাই চুক্তিটি বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে ওই কোম্পানি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলা পরিচালনায় অনেক অর্থ ব্যয় হয়। পরে বাংলাদেশ একটা শাস্তি পায়। প্রায় ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ১০ হাজার কম্পিউটার তো গেলো, উল্টো আরও ৬০ কোটি টাকা দিতে হলো একটা দেশের সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তের কারণে। এ ধরনের সরকার প্রধান থাকলে দেশের উন্নতিটা কীভাবে হবে। সেটা বুঝে দেখেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে গেছে। যেখানে পারেনি, সেখানে আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে সবাই অনলাইনে কাজ করছে। আমরা এখন ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি করছি।
দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় কাজ করতে সুবিধা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা এবং আইসিটি শিল্পের বিকাশে এই ১৩ বছরে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় আমাদের সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। সে কিন্তু অবৈতনিক। এটা আমি জানিয়ে রাখি। কারণ, অনেক সময় অনেকেই অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলে। দেশের কল্যাণে ও শিক্ষায় সে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের মানুষের জন্য।
রফতানি পণ্য গুণগত মান পরীক্ষায় সরকার পরীক্ষাগার বাড়িয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির আমলে চিংড়ি মাছের মধ্যে লোহা ও পেরেক ঢুকিয়ে দিয়ে সেটা ইউরোপে রফতানি করার ফলে আমাদের রফতানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে অনেক দেনদরবার করে সেটা ঠিক করি। আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্যকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে সনদ দেওয়া অপরিহার্য। তাই আমরা পরীক্ষাগারের সক্ষমতা বাড়িয়েছি। বিভিন্ন এলাকায় পণ্যভিত্তিক টেস্টিং ল্যাবরেটরি করার উদ্যোগ নিয়েছি।
গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রদান করছি। আমরা শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় বই দিচ্ছি। তবে আমরা জোর দিচ্ছি বিজ্ঞানের ওপর। এই শিক্ষায় যাতে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে সেজন্য আলাদাভাবে ফেলোশিপ দেওয়া হচ্ছে। এই যুগে যেসব দেশ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে, তারাই অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। কাজেই উন্নতি করতে হলে গবেষণা একান্ত প্রয়োজন।
দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা কম হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের দেশে গবেষণাটা খুব কম হচ্ছে। আমাদের দেশে খুব কম চিকিৎসক আছে। আসলে তারা যতটা না রোগীর সেবা দিতে আগ্রহী, ঠিক ততটা আগ্রহ গবেষণার দিকে নেই। হাতেগোনা কয়েকজন নিয়মিত গবেষণা করেন। এক্ষেত্রে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণাটা একান্ত দরকার।
সরকার প্রতিবছরই গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দ রাখছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মৌলিক গবেষণার সঙ্গে প্রায়োগিক গবেষণার দিকে জোর দিতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই গবেষণা প্রয়োজন। কারণ, গবেষণা ছাড়া উৎকর্ষ লাভ করা যায় না। এসডিজি গোল অর্জন করতে গবেষণার প্রয়োজন। দেশের অনেক সম্পদ রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করতে গবেষণার প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী।