সুভাষ দে »
আমাদের দেশে করোনা শুরুর পর ৭ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সংক্রমণ কমার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিন সংক্রমণ ১৫০০ থেকে ২০০০ এর মধ্যে রয়েছে। মৃত্যু ৫৮০০ এ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু কিছুটা কমলেও স্বস্তির কোন অবকাশ নেই। করোনা উপসর্গ নিয়ে আমাদের দেশে মৃত্যু আড়াই হাজারের বেশি। করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এসব মৃত্যুর কারণ নিয়ে যথাযথ অনুসন্ধান বা গবেষণা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রতিদিন মৃত্যু বা শনাক্তের কেবল সংখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অনুরূপ সুস্থতারও বড় সংখ্যা দেওয়া হচ্ছে। করোনা আক্রান্তদের কেমন চিকিৎসা হচ্ছে কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা কিরূপ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন তা জানা যাচ্ছে না সঠিকভাবে। বিশেষজ্ঞরা টকশোতে নানা কথা বলছেন, অধিকাংশই সরকারের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতিÑঅব্যবস্থাপনা নিয়ে, এসব নিয়ে আলোচনা হবে, এটি স্বাভাবিক কিন্তু যে রোগটি আমাদের সমাজÑঅর্থনীতিতে নিয়ত অভিঘাত সৃষ্টি করে চলেছে তার সম্পর্কে জনগণ সামান্যই জানছে। কোনোরূপ গবেষণা নিয়ে প্রচেষ্টার খবর নেই। সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির টিকা আবিষ্কার ও এর ট্রায়াল সম্পর্কে কিছু তথ্য এসেছে মাত্র। এর আগে ভাইরাসের জিনোম আবিষ্কার নিয়ে একটি তথ্য আমরা পেয়েছি।
করোনার অভিঘাতের মধ্যেই জনজীবন স্বাভাবিক করতে সংক্রমণের প্রথম ৩ মাসের মধ্যেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলেই এই আর্থÑসামাজিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়েছে। এবারও তিনি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে দেশবাসীকে ক্রমাগত সতর্ক করে চলেছেন এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। তিনি বারবার মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয়, জনগণের মধ্যে বিপদের মাঝেও এ ব্যাপারে সাড়া খুবই কম। গ্রামের মানুষ খুব কমই মাস্ক পরেন। শহরে এখন মাস্ক পরার প্রবণতা কমে গেছে। জনগণের মধ্যে সচেতনতার এই যে ঘাটতি তা যেকোনো মুহূর্তে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, আমাদের অসচেতনতা আর ঔদাসীন্যের কারণে, করোনার আঘাতে যে কোনো সময় তা স্থবির হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে, পরিবারÑসমাজের আবশ্যকীয় কাজ, জীবনÑজীবিকার কাজ সারতে হবে, আর এটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলে এবং সচেতনতার ক্রমাগত চর্চার মধ্য দিয়ে। প্রথমদিককার ‘লকডাউনের’ বিষাদময় অভিজ্ঞতা আমরা কি ভুলে গেছি?
ইউরোপÑআমেরিকায় এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এবং তা ক্রমেই বিপদজনক হয়ে উঠছে। ইউরোপে একদিনেই (বৃহস্পতিবার ১৫ অক্টোবর) শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ, ১২ অক্টোবরে ছিল ১ লাখ। সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় এবার শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা বেশি হওয়ার রোগী বেশি মিলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে একদিনেই ৮৩ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে সরকারি হিসেবেই আক্রান্তের সংখ্যা ৮৩ লাখের কাছাকাছি। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক অ্যান্ড এভালুয়েশান (আইএইচএসই) গবেষকরা বলছেন, যদি আমেরিকানরা মাস্ক না পরেন তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ লাখ হতে পারে। শীতের কারণে অনেকে ঘরে থাকবেন। বিশেষ করে বদ্ধ জায়গায় ও দুর্বল বায়ু নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়াবে দ্রুত। মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেক্স আজারও বলেছেন, ব্যক্তি মানুষের আচরণের ওপর নির্ভর করে দেশজুড়ে করোনার সংক্রমণ কিরূপ হবে। (দৈনিক আজাদী ২৫ অক্টোবর) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আধানম গেব্রেয়াসুস সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সামনের কয়েকটি মাস খুবই কঠিন হতে যাচ্ছে, কিছু কিছু দেশ বিপজ্জনক পথে রয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বহু দেশে করোনা ভাইরাস জ্যামিতিক হারে বাড়ছে (সূত্র: ঐ) যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্যের ২১টি এলাকায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীরা শীতকালকে বিপজ্জনক বলছেন। আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে মার্চ মাস থেকে, তখন গরমের মৌসুম, সামনের কয়েক মাস শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় আগে থেকে সতর্ক না হলে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে আমরাও ভয়াবহ বিপদে নিক্ষিপ্ত হতে পারি।
আমাদের অর্থনীতির যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে এবং তা যে ক্রমঅগ্রগতির পথে, সেটি আমাদের অসচেতনতায় বাধাগ্রস্ত হতে পারে, তখন আমাদের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। জীবনÑজীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং কোনোরূপ শিথিলতা কিংবা ঔদাসীন্য নয় বরং নিজের, পরিবারের ও অন্যদের সুরক্ষায় আমাদের প্রস্তুতিতে কোনরূপ ঘাটতি থাকা চলবে না।
২.
করোনার ভয়াবহতার সাথে আরেক ধরণের শঙ্কা আচ্ছন্ন করছে মানুষকে আর তা হল নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। করোনা ও মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে যাচ্ছে মানুষ। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকায়, কোথাও কোথাও ৫০ টাকার বেশি। আলুর দাম খুচরায় ৩৫ টাকায় সরকার বেঁধে দিয়েছে। তবে আলু আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ব্যবসায়ী সি-িকেট বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সরকারকে বোকা বানাচ্ছে আর জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে। আলু কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫Ñ৫০ টাকায়। পেঁয়াজ, আদা, রসুনের দাম আগেই বাড়তি। মিয়ানমার থেকে আনা পেঁয়াজ দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করছে আমদানিকারকÑআড়তদার, খুচরা ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারি কোথাও নেই। টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তবে চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম, কিছু লোকের চাহিদা মিটছে কিন্তু অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে মানুষের, ধাক্কাধাক্কি তর্কাতর্কি, মানুষ দিশেহারা হচ্ছে। করোনার মধ্যে টিসিবি’র পণ্য কিনতে ঝুঁকিও বাড়ছে। তার চাইতে ভাল পুনরায় রেশনিং ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। প্রতিনিয়ত যেভাবে মানুষ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ঠকছে আর অসহায় বোধ করছে তা তার মনুষ্যসত্তাকে অবদমিত করছে। তাদের শ্রমেÑমেধায় জাতি পুষ্ট হচ্ছে, তাদের টাকায় সরকার চলছে আর গুটিকয়েক মানুষের চক্রান্ত, সি-িকেট আর মুনাফাবাজির শিকার হবে সাধারণ মানুষÑএটি কাম্য নয়।
অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা নেই। মজুদ কিংবা চাহিদা নিয়ে জরিপ, পরিসংখ্যান, মনিটরিং নেই। সরকার বলছে চালের মজুদ আছে। ডিসেম্বরে আমন ধান উঠবে। তাহলে এখন কেন চালের দাম বাড়ছে। আলুর বেলায়ও সরকার বলছে চাহিদার তুলনায় আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবে করোনার প্রথম ৩ মাসে খাদ্য সহায়তায় আলু একটি প্রধান আইটেম ছিল। এরপরও মজুদ যদি ভালো থাকে তাহলে আলুর দাম এভাবে আগের সকল রেকর্ড ভাঙবে কেন? কদিন পরেই নতুন আলু আসবে। আর বাড়তি মূল্য তো উৎপাদনকারীÑচাষিরা পাচ্ছে না। পাইকার, কোল্ড স্টোরের মালিক এই অবিশ্বাস্য মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। সবজির দামও অতিচড়া, ৭০-৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য বৃষ্টিÑবন্যা তার একটি কারণ। এখানেও উৎপাদক আর ভোক্তারা ঠকছে।
করোনার দুঃসময় চলছে, মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। চাকরি হারিয়েছে অনেকে, ক্ষুদ্র কুটির, মাঝারি শিল্পের দৈন্যদশা, ছোট ব্যবসায়ীরা মূলধনের অভাবে দাঁড়াতে পারছে না। গ্রামের প্রান্তিকÑদলিত মানুষের অবস্থা আরো খারাপ। ১/২ শতাংশ মানুষ ৯৮ শতাংশ মানুষের সম্পদ কবজা করে রেখেছে। করোনার এই সময়ে ব্যবসায়ীদের, ধনীদের পোয়াবারো। কেবল নিত্যপণ্য নয়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং সকল সেবার মূল্য বেড়েছে। এসব এখন কিছু উচ্চবিত্ত ছাড়া জনগণের সাধ্যের বাইরে। সামনে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার চাপ বাড়বে। নিত্যপণ্যের সংকটও দেখা দেবে। এ অবস্থায় সময়ের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া সংগত নয়। এখন থেকেই চাহিদা, মজুদ নিরূপণ করতে হবে। অসাধু সি-িকেট যেভাবে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি আর মূল্য বাড়াচ্ছে তাতে করোনার এই সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। তাই এখন থেকে বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে পণ্য আমদানির পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনার এই সময় চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক রাখতে না পারলে তা হবে মানুষের জীবন ও অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাড়তে যখন অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু হুঁশ হয়। তখন তাদের পদক্ষেপ আর কাজ দেয় না বরং বাজারকে আরো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় নিয়ে যায়। চাল, আলু, পেঁয়াজ, মশলার মূল্য থেকেই এর আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। যে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সকল প্রকার সাহায্য দেয়া। বিশ্বে যেভাবে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা দেখা দিচ্ছে, করোনাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে, সেখানে আমাদের কৃষি এবং কৃষকই ভরসা, সেই সাথে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনা দিতে হবে যাতে মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়। অর্থাৎ সময় থাকতে প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি করে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে সকল প্রকার প্রণোদনা দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক