টেস্ট করায় না বলে হয়তো তারা শনাক্ত হচ্ছে না, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি: চিকিৎসকদের অভিমত #
ভূঁইয়া নজরুল »
একেখান-জিইসি রুটে সবুজ টেম্পু চালায় সগির আহমেদ। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী টেম্পুর ভেতরে চারজনের বেশি লোক নেয়া নিষেধ থাকলেও তার পাশের সিটেও একজন প্রতিনিয়ত। তার মাস্কটিও থুতনিতে লেগে থাকে সবসময়। প্রতিদিন অনেক যাত্রী তার পাশে বসে যাতায়াত করলেও তিনি এখনো করোনায় আক্রান্ত হননি।
ভ্যানে করে পশ্চিম ফিরোজশাহ ও কৈবল্যধাম এলাকায় কাঁঠাল বিক্রি করেন হেলাল আহমেদ। মাস্ক ছাড়াই প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বললেও করোনার কোনো ভয় নেই তার মধ্যে।
শুধু ওই দুইজন নয়, সমাজের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া প্রায় সব মানুষের ক্ষেত্রে একই চিত্র। তাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের খবরও খুব কম।
আমবাগান বস্তির বাসিন্দা তোফায়েল আহমেদ ঝাউতলা বাজারে কর্মচারীর কাজ করেন। করোনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই, করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে, কে খাওয়াবে? এধরনের জ্বর-সর্দি কাশি আমাদের সবসময় থাকে। আবার চলেও যায়। তাই এটা নিয়ে এতো ভয়ের কিছু নেই।’
শুধু বাজারই নয়, ভাসমান হকার থেকে শুরু করে, যানবাহন শ্রমিক, দোকানের সেলসম্যান, নির্মাণ শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া অনেক মানুষের মধ্যে করোনার ভয় নেই।
চট্টগ্রামে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৭ হাজার ২২০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ১৫৩ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৮৯৫ জন। সিভিল সার্জনের দপ্তরে সমাজের অর্থনৈতিক শ্রেণীভিত্তিক কোনো তথ্য না থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষের আক্রান্তের সংখ্যা খুবই নগণ্য বলে জানালেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী।
তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান রয়েছে তাতে নগরীর বস্তিগুলোতে করোনায় আক্রান্তের চিত্র প্রায় নেই বললেই চলে। প্রথমদিকে আমরা বস্তিগুলো নিয়ে ভয়েছিলাম, তবে সেসব এলাকার মানুষ তেমন আক্রান্ত হচ্ছে না। কিন্তু একবার যদি বস্তিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তবে তা ভয়াবহ হবে।’
আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে নেই নিম্নআয়ের মানুষ
নগরীর আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে চিকিৎসায় তেমন কোনো খরচ লাগে না। তাই করোনা উপসর্গ কিংবা করোনা নিয়ে নি¤œ আয়ের মানুষ সহজেই সেখানে যেতে পারে। এবিষয়ে পোর্ট কানেকটিং রোডে করোনা আইসোলেশন সেন্টারের উদ্যোক্তাদের একজন সাদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমাদের এখানে ৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এদের সকলে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সদস্য। সাধারণত ঘরে আইসোলেশনে থাকার জায়গা না থাকায় তারা এখানে আসছে। এতোদিন ধরে আমরা এটি পরিচালনা করছি কিন্তু এখন পর্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন রোগীও দেখিনি।’
একই কথা বলেন বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ডা. হোসেন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি শ্রমিক অধ্যুষিত সল্টগোলা সিম্যানস হোস্টেল এলাকায় চেম্বার করি এবং আমাদের বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড হাসপাতালে নিম্ন আয়ের মানুষের করোনা দেখছি না। আমাদের হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৯ জনের সবাই অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সদস্য।’
অন্যদিকে চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্ত ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া বলেন, ‘আমার এখানেও নিম্ন আয়ের মানুষের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। তাই বলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে না এই কথাটি বলা যাবে না, তারা শেষ মুহূর্তে হয়তো চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে গিয়ে থাকতে পারে।’
এবিষয়ে কথা হয় করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামে প্রথম থেকে কাজ করে আসা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রবের সাথে। তিনি বলেন, ‘সরকারি এই হাসপাতালে অনেক রোগী আসে কিন্তু এদের বেশিরভাগই অবস্থাসম্পন্ন কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। সমাজের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম।’
নগরীতে কোনো বাড়ি বা বাসা করোনা আক্রান্ত হলে তা লকডাউনের দায়িত্ব নেয় মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ শাখা। এবিষয়ে বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার ওয়ারিস আহমেদ বলেন, নগরীতে পাকা ভবনে লকডাউনের হারই বেশি। টিনশেড বা সেমিপাকা ঘরের পরিমাণ কম। আর এতে বুঝা যায় বস্তিগুলোতে এখনো সেই হারে আক্রান্ত শুরু হয়নি।
নিম্ন আয়ের মানুষ কি আক্রান্ত হচ্ছে না?
সমাজের খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে না তা মানতে নারাজ চট্টগ্রামে ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া। তিনি বলেন, ‘খেটে খাওয়া এই মানুষকে ভোর হলেই পেটের দায়ে বের হতে হয়। তাই তাদের মধ্যে করোনার ভয় কাজ করে না। তাই দীর্ঘসময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দেয়ার তাগিদ তারা অনুভব করে না।’
বিদ্যুৎ বড়–য়া বলেন, ‘হয়তো তারা আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় তারা হয়তো তা ওভারকাম করে যাচ্ছে। আর টেস্ট না করানোর কারণে তারা শনাক্ত হচ্ছে না।’
করোনায় মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে এমন রোগ যেমন ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, হার্টের সমস্যা, কিডনি, উচ্চরক্তচাপ নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে প্রায় নেই বলে জানান চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুঝুঁকি থাকা রোগগুলো নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে না থাকার কারণে তারা হয়তো জ্বর-কাশি অনুভব করলেও সহজেই সুস্থ হয়ে যায়।’
একই মন্তব্য করেন ডা. হোসেন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নিম্নআয়ের মানুষগুলো সারা বছরই জ্বর, কাশি ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তারা এসব রোগে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই তাদের কেরোনা প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।’