রায়হান আহমেদ তপাদার :
বর্তমানে আমরা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বৈশ্বিক মহামারির বহুমাত্রিক হুমকির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য লডাই করছি। এই দ্বিতীয় সংকটটি সরকারগুলোকে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে বন্ধ করে দিলে বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন চাপিয়ে দিতে বাধ্য করেছে।একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই মানবতা কমপক্ষে দুইটি বড় বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।চলমান সংকট পরবর্তী ক্রান্তিকালের কথা মানবতাবাদীরা অনুগ্রহ করে এসাইনমেন্টের মধ্যে রাখুন। এখন কিন্তু আসল ক্রান্তিকাল নয়। কর্মহারা অভুক্ত মানুষগুলো এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেলে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে নতুন কর্মকা-ের সাথে জড়াতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হবে। গ্লোবাল ইকোনমির কথা ভেবেছেন! বিভিন্ন দেশের অনেক কর্মসংস্থান লে অফ হয়েছে। নতুন সম্ভাবনার দ্বার মোটেই খোলা নেই বরং দেশের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া কর্মস্থানগুলো পুনরায় চালু করতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে। স্বল্প আকারে চালু হলেও কর্মহারা মানুষগুলোর অধিকাংশ বেকার হয়ে পড়বে।
ইউরোপ আমেরিকার উন্নত যে সকল দেশ আমাদের পোশাক খাতের ক্রেতা, তাদের ঘুরে দাঁড়াতে ন্যূনতম আগামী একবছর সময় নিবে। এই সময়ের মধ্যে সারা বিশ্বে দেখা যাবে মারাত্মক আর্থিক দৈন্যতা। আমাদের দেশের যে সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান অন্যদেশের কাঁচামাল নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে, সে সকল দেশের অবস্থা খুবই নাজুক বিধায় অর্থনীতি মারাতœক হুমকি ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত আগামী একবছর আমাদের দেশের মানুষের জীবন জীবিকা ভিন্নতায় রূপ নিতে পারে। আলোচিত সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে জীবন বাঁচানোর তাগিদেই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের বিশাল একটা সংখ্যা নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন আইনবহির্ভূত কর্মকা-ে জড়াতে পারে বলে প্রতীয়মান। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মানবতাবাদী ও তাদের সংগঠন সহ সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘমেয়াদি সাবসিডির প্রয়োজন হবে।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে খ্যান্ত হচ্ছে না, এটার পরবর্তী ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া প্রতিটি ভিকটিম দেশকে খুব সহজে অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক মুক্তি দিতে সক্ষম হবে না বলেই প্রতীয়মান। উন্নত দেশগুলোতে চলমান পরিস্থিতিতে মুভমেন্ট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে জেল, জরিমানা ও গুলির অর্ডার পর্যন্ত রয়েছে, যা আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় লক্ষ্য করেছি। অথচ বাংলাদেশ সরকার মানুষের প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে অন্যদেশের তুলনায় এখনো অনেকাংশে লিবারেল রয়েছে শুধু সার্বিক স্বার্থে। এই সহনশীলতার অর্থ এই নয় যে, আমি এই মুহুর্তের জন্য স্বাধীনচেতা। বারমাসি স্বাধীনতায় আমরা অভ্যস্ত হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইন কানুনের শিথিলতা বা সংবিধিবদ্ধতা মেনে চলাও স্বাধীন দেশের মার্জিত নাগরিক হিসেবে আপনার বাহ্যিক আচরণের মধ্যে পড়ে। তাহলে আমরা অনেকেই শুদ্ধাচারের কোন লেভেলে আছি, একটু ভাবার সময় এসেছে। কারণ বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেলে খুব অল্প সময়েই মৃত্যুহার ম্যাসিভ আকার ধারণ করতে পারে, যা আমাদের সক্ষমতা দিয়ে নিবারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে যাবে বিধায় সচেতনতা ও সাবধানতাই পারে এই মহামারি থেকে অনেকাংশে রক্ষা করতে। মৃত্যুকে ভয় পায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর হলেও অসচেতনতা ও গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে অকাল বা অপ্রত্যাশিত মৃত্যুকে অনেকেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই আলিঙ্গন করতে গা ভাসিয়ে চলাফেরা করছে।
বিভিন্ন দেশের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে আমারা শিক্ষা নিতে পারিনি, পারিনি মৃত্যুকে কিভাবে জয় করে নিজ পরিবার ও দেশকে সুরক্ষিত রাখা যায়। আমরা কিন্তু যথেষ্ট সময় পেয়েছি নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করতে কিন্তু দুর্ভাগ্য, কথিত যুক্তিবিদ্যায় পা-িত্য অর্জনকারী বাংলাদেশের মানুষ অনুমান নির্ভরতায় আস্থাশীল হয়ে নিজ পরিবারের পাশাপাশি অন্যদের জন্য এক একটি এটম বোমা ক্যারি করে চলেছি, যা আমাদের এই হুজুগি চলাফেরায় বিস্ফোরিত হয়ে বড় ধরনের হতাহতের দৃশ্যমান চিত্রের সৃষ্টি করতে পারে।
সমাজের বিত্তবান মানুষ, স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন দেশের ক্রান্তিলগ্নে মানবতার হাত সম্প্রসারিত করবে এটাই নিয়ম এবং সরকারের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু ভিকটিম জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে সরকারের নির্দেশনা মেনে যে প্রক্রিয়ায় অগ্রগামী হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ের প্রতি আমরা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্যপরায়ণ, সেটাই মূখ্য বিষয়। জনসমাগম রোধকল্পে হোম কোয়ারেনটাইনের বিষয়টি নিশ্চিত করার আহবান থাকলেও আমরা নিজেদের শো অফ করার জন্য অসচেতন ও অভুক্ত শ্রেণির মানুষগুলোকে একীভূত করে একটি পুলিন্দা বন্টন করতে দশ বারটি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। বাহ! দুর্ভাগ্য আমাদের। সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে গিয়ে নিরাপদ জনগোষ্ঠীকে আমরা অনিরাপদ করতে একটি পুলিন্দা দিয়েই টোপ ফেলাচ্ছি।
প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী সারাজীবনই ধনবান ও লিডিং শ্রেণির মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নের ধারক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। চলমান পরিস্থিতিতে হোম কোয়ারেনটাইন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা বহুলাংশে উপেক্ষিত হচ্ছে আমাদের আমজনতার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে।
আমরা যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হই, প্রশাসনইবা আইনসিদ্ধভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিশ্চিত করার কতটা সক্ষমতা রাখে। কঠোর হাতে নিশ্চিত করতে গেলে কথিত মানবতাবাদীরাই রাস্তায় নেমে আসে বা বিভিন্নভাবে সোচ্চার হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী/ নি¤œ আয়ের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা বিবেচনায় মুভমেন্ট ক্ষুদ্র মাত্রায় আনার ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা হলো দুমুঠো ডাল ভাতের প্রশ্নে। এই প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে দৈনিন্দিন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য বিনামূল্যে ঘরে ঘরে খাবার পৌছে দিচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জন্যও বিনামূল্যে নিসংকোচে হট লাইন ব্যবহার করে সাহায্য চাইলে বিনামূল্যেই বিতরণের ব্যবস্থা চালু করেছে। চালু রয়েছে সকল শ্রেনীর মানুষের জন্য পুলিশের হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। চাহিদা অনুযায়ী মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে আপনার ঘরে পৌছে যাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এই সকল সুবিধার পিছনে উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো জনসমাগমকে একদম নি¤œমুখী করে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখা।
কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে অনুদানের চিত্র পরিস্থিতি বিবেচনায় সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রসমূহ তাদের মূল দায়বদ্ধতা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। এর ফলে অতি ধনী আইকনরা তাদের সম্পদের ভিত্তি প্রসারিত করতে এবং সামাজিক বৈধতাকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন। করোনা মহামারি চলাকালীন বিল গেটস, জ্যাক মা এবং জেফ বেজোসের মতো ধনকুবেরের অতিমাত্রায় পরোপকারী অনুদান তাদের সম্পদ আহরণের সামাজিক বৈধতা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়াসকে উপস্থাপন করে। এর লক্ষ্য, দুর্বল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের চেয়ে বিশ্ব অর্থনৈতির স্বাস্থ্য রক্ষা করা। এই নব্য উদারীকরণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী জনবিনিয়োগ হ্রাস এবং ব্যক্তিসংস্থাগুলোর ভূমিকাকে প্রসারিত করেছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিন্যাসের পুনর্গঠনের আহ্বান না জানিয়ে ধনকুবেরগণ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাদের নৈতিকতার বাড়াবাড়ি দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করার উপায় হিসাবে পরোপকারের আশ্রয় নিয়েছে। তারপরও ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, করোনা মহামারি বিশ্ববাসীর সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে ব্যক্তিকে বাণিজ্যিক ও অমানবিক সামগ্রীতে পরিণত করা তথাকথিত নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর। এই বৈশ্বিক মহামারি রাষ্ট্রসমূহের সামনে সৃষ্টি করেছে রূপান্তরকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত জীবন ও মর্যাদাকে অর্থবহ করার, জনস্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বিনিয়োগের এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি পুনর্বিন্যাসের সময়োচিত উপায় অনুসন্ধানের। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে পরবর্তী ক্রান্তিকালের কথা মাথায় রেখেই আমাদের মানবতার হাতগুলো দীর্ঘমেয়াদি সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি সামর্থবানদের শুদ্ধাচার নির্ভরতায় প্রস্তুত হওয়া দরকার। আল্লাহ আমাদের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সকলকে সুরক্ষিত রাখুক। উন্নয়নশীল বাংলাদেশ এগিয়ে যাক কাঙ্খিত লক্ষ্যে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের প্রত্যয়ে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ই-মেইল :[email protected]