রায়হান আহমেদ তপাদার »
কোভিড-১৯ শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত হেনেছে জীবনেও। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। তারা সব মিলিয়ে ২ লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। তবে করোনার কারণে পুরো অভিবাসন খাতই সংকটে পড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এককভাবে শুধু সৌদি আরবেই আছেন ২০ লাখ বাংলাদেশি। আরব আমিরাতে আছেন অন্তত ১৫ লাখ। এ ছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনে গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশী আছেন। একে তো করোনা মহামারি, তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। ওদিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশিরাও একইভাবে নানা সংকটে। এ ছাড়াও করোনা পরিস্থিতির কারণে ছুটিতে আসা দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি একই দুশ্চিন্তায় আছেন। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আবার কবে তারা কাজে যোগ দিতে পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না জানেন না। দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা যেখানে ফের বিদেশে যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন, তখন বিদেশে থাকা প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন বহুমাত্রিক সংকটে।
কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। করোনা কোন ধরনের অস্ত্র নয়, নয় কোন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের এক ক্ষুদ্র আলোক আণুবীক্ষণিক বক্ষুর কাছে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ অসহায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে করোনাভাইরাস। একদিকে প্রতিনিয়ত যেখানে নতুন করে গোটা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। এ ছাড়াও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীকে এক বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে; যা আগামী দিনগুলোতে আমাদের সবার জন্য হতে চলেছে এক বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
গত ৩১ জানুয়ারি ইউরোপে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। ইতালির রাজধানী রোমে সর্বপ্রথম এক চীনা পর্যটকের শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। দুই মাসের ব্যবধানে পুরো ইতালির চিত্র সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় গোটা ইতালি। এক সময় প্রতিবেশী ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রিয়াসহ ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও গত জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আবারও করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হতে থাকে। অনেকে একে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। সেøাভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রীস, মন্টিনিগ্রো, অস্ট্রিয়া-এসব দেশ প্রথম ধাপে করোনা মোকাবেলায় যেখানে ছিল অনেকটা সফল, দ্বিতীয় ধাপে এসব দেশকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।
তা ছাড়াও দীর্ঘদিন লকডাউন কিংবা জরুরী অবস্থার কারণে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট, কফিশপ এবং পানশালাগুলো বন্ধ থাকায় তাদের অনেকে বলতে গেলে একটা দীর্ঘ সময় কর্মহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে ইউরোপের অনেক দেশের সরকার ঘোষণা দেয়, যাদের বৈধ ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে এবং কোন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধভাবে যারা কাজ করেন, তাদের এ লকডাউন পরিস্থিতির মাঝেও বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করার জন্য, যদিও সে সময় কারও কাজ না থাকে। তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন একটা আশার খবর বয়ে আনতে পারেনি। কেননা তারা কেউই ফুলটাইম ওয়ার্কার না এবং বেশিরভাগ দেশে তারা কোন ধরনের চুক্তি ছাড়াই কাজ করে থাকেন। করোনাভাইরাসের বিক্ষার রোধ করার জন্য ইউরোপের দেশগুলো লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা জারি করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক প্লেসগুলোতে মানুষের যাতায়াতের ওপর এক ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের একটা বড় অংশ নিজের খরচে পড়াশোনা করেন, যাদের আমরা সেলফ ফাইন্যান্সিং স্টুডেন্ট হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকি। তাদের অনেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করেন। মূলত নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানোর জন্য তারা অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের পেশাভিত্তিক কাজের সন্ধান করে থাকেন ইউরোপে আসার পর। অনেকে আবার পার্টটাইম কাজের মাধ্যমে নিজেদের টিউশন ফি জোগাড়ের এক প্রচেষ্টা চালান। ইউরোপের কিছু দেশ সরকারিভাবে সে দেশে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীকে আর্থিকভাবে সহায়তার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা উল্লেখযোগ্য কোন কিছু নয় সে অর্থে।
যেমন, স্লোভেনিয়ার বর্তমান সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সে দেশে বসবাসরত শিক্ষার্থী, যাদের স্লোভেনিয়ার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড রয়েছে, তাদের সবাইকে এপ্রিল এবং মে-এ দুই মাস ১৫০ ইউরো করে আর্থিক অনুদানের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ১৫০ ইউরো বলতে গেলে স্লোভেনিয়াতে কারও এক মাস চলার জন্য খুব একটি বড় এ্যামাউন্ট না। অনেক দেশের সরকারের পক্ষ থেকে সে দেশের স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সুবিধা দেয়া হলেও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন সে রকম আর্থিক সহায়তা ছিল না বললেই চলে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এককালীন যে অর্থ সহায়তা প্রদান করে, সেটাও তেমনভাবে উল্লেখ করার মতো কোন বড় একটি এ্যামাউন্ট ছিল না। অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং পলিসির কারণে সরাসরি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চাইলে কেউ সহজে টাকা পাঠাতে পারেন না। তাই এ পরিস্থিতিতে অনেকে বাধ্য হয়ে হুন্ডির আশ্রয় নেন। সেক্ষেত্রে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো নিকটস্থ কারও সন্ধান করা, যিনি বাংলাদেশে টাকা পাঠাবেন। তিনি সে টাকা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে সরাসরি তার হাতে তুলে দেন এবং বাংলাদেশে থেকে তার পরিবারের কোনো সদস্য ওই লোকের বিশ্বক্ষ কারও কাছে এর সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দেন। এতে সরকারের রেমিটেন্স প্রবাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এ ছাড়া বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ইউরোপে এ সময় ট্যুরিজম সেক্টরটি সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা থাকে। তবে এ বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে লকডাউন কিংবা জরুরী অবস্থা তুলে নেয়ার পরও অনেকেই কাজে ফিরতে পারছেন না।
অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাদের অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতির মাঝখানে যখন আমরা দাঁড়িয়ে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় ধাপে করোনার সংক্রমণ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে চলেছে। যেহেতু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফের করোনার আঘাত এসেছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মনে একটা প্রশ্ন-আগামী সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রমও কি অনলাইনে পরিচালিত হবে? যদি গেল সেমিস্টারের মতো আগামী সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হয়, সে ক্ষেত্রে তাহলে বিদেশে অবস্থান করার যৌক্তিকতা কতটুকু? কিংবা সে ক্ষেত্রে কেনই বা পুরো টিউশন ফি প্রদান করতে হবে? কিংবা, করোনা পরিস্থিতিতে যে কোন সময় যদি কোন দেশের দরকার বলে বসে, এখনই সে দেশে অবস্থানরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের সে দেশ থেকে চলে যেতে হবে? করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেক প্রবাসীর জীবনকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন কাজে যেতে পারেননি অনেকে, এমনকি এখনও যে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসতে পেরেছেন, এমনটি নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যারা মূলত নিজ খরচে পড়াশোনা করার জন্য ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন, তারা রীতিমতো চিন্তিত পরবর্তী সেমিস্টারের টিউশন ফি পরিশোধ নিয়ে। কেউবা আবার চিন্তিত টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রিনিউ করা নিয়ে।
আবার যেহেতু এখনও অনেকে পুরোভাবে পার্টটাইম চাকরিতে ফিরতে পারেননি এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং পলিসির কারণে দেশ থেকেও সেভাবে টাকা আনা সম্ভব হয় না, তাই অনেকে অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ইউরোপে তাদের টিকে থাকা। কেউ আবার দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। এ অবস্থায় অনেকে আমাদের দেশের সরকারের হক্ষক্ষেপ কামনা করেছেন, যাতে বাংলাদেশ সরকার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে একটা কার্যকরী সমাধানের পথ বের করতে পারে। অপরদিকে করোনাকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঢেউ আছড়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যেও। সৌদি আরবও এর বাইরে নয়। স্থবিরতা নেমে এসেছে সেখানকার নানা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে। ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক কর্মী সেখানে কাজ হারিয়েছেন। এই স্থবিরতা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী কর্মীকে দেশে ফিরে যেতে হবে। এভাবেই ভাল-মন্দে কেটে যাচ্ছে প্রবাসীদের আটপৌরে সংগ্রামী জীবন। যেহেতু সৌদি আরবে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় না, তাই সব প্রবাসীর প্রত্যাশা থাকে কাজ শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু মহামারি করোনা যেন সব আশায় গুড়েবালি। তবে তারা যেমন আছেন, যেভাবে আছেন তা নিয়ে খুব বেশি না ভেবে চিন্তিত আছেন দেশের প্রিয় মানুষগুলোর জন্য। তাদের চাওয়া একটাই, ভাল থকুক তাদের স্বজনরা।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট