আগামী তিন সপ্তাহ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ: বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক#
হাসপাতালগুলোতে কমছে রোগীর সংখ্যা: সিভিল সার্জন#
মুমূর্ষ রোগীর চাপ কমে আসছে: চমেক হাসপাতাল পরিচালক#
ভূঁইয়া নজরুল :
নগরীর উন্মুক্ত স্থানগুলোতে বেড়েছে মানুষের বিচরণ। মাস্ক ছাড়া অবাধে চলাচলও বেড়েছে। চট্টগ্রামে একসময় করোনা নমুনা দেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন থাকতো, এখন আর তা দেখা যায় না। আক্রান্তের হার মে মাসের শেষ সপ্তাহে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। জুনে গড়ে ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। এখন তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। একসময় হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির জন্য হাহাকার ছিল, কিন্তু এখন হাসপাতালগুলোতে বহু শয্যা খালি পড়ে আছে।
নমুনা দেয়ার ক্ষেত্রে নগরীতে আর আগের চিত্র নেই জানিয়ে ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালের ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আগে যে পরিমাণ নমুনা দেয়া হতো এখন আর তেমন নেই। এখন আমরা দিনের রিপোর্ট দিনে দিচ্ছি। একইসাথে যেসব নমুনা পাওয়া যাচ্ছে এর ৮০ শতাংশই বিদেশগামী যাত্রীদের। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নমুনা দেয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। শুধুমাত্র কেউ অসুস্থ হলে নমুনা দিতে আসছে।’
জানা যায়, চট্টগ্রামে গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ নমুনা সংগ্রহ হয় ২০ জুলাই, ১ হাজার ১১৫ টি। এদের মধ্যে পজিটিভ হয় ১৩৮ জনের, শতকরা হিসেবে যা ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এছাড়া গত ২২ জুলাই ১ হাজার ৭৮ জনের মধ্যে পজিটিভ হয় ১৪৮ জনের, শতকরা হিসেবে ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। শনিবার ৩৮৩ জনের মধ্যে ৭০ জনের করোনা পজিটিভ হয়, শতকরা হিসেবে যা ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। নমুনা ও আক্রান্তের হার কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের হাসপাতাল ও করোনা আইসোলেশন সেন্টারগুলোতেও এখন আর তেমন রোগী নেই। সরকারি প্রধান দুই হাসপাতাল ছাড়া বকি সব হাসপাতালেই রোগী প্রায় নেই বললেই চলে।
হাসপাতালগুলো প্রায় রোগীশূন্য
করোনা চিকিৎসায় দেশের প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল চালুর পর থেকেই সুনাম কুড়িয়েছে। হাসপাতালটিতে একসময় পরিপূর্ণ রোগী ছিল। মাত্র ৫০টি সিট থাকায় অনেককে ভর্তি করানো যায়নি। কিন্তু এখন সেই হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছে মাত্র চারজন। এবিষয়ে ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহি ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া বলেন, ‘এখন মানুষ অনেক সচেতন। আর করোনা নিয়ে ভয়ও তেমন একটা নেই। মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে, এতে আক্রান্তের হার কমে এসেছে। একারণে হাসপাতালগুলোতে কমছে রোগীর সংখ্যা।’
পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা করোনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাদের জন্য পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ চালু করে ফিল্ড হাসপাতাল। কিন্তু ৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা মাত্র দুই জন। এবিষয়ে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. নাহিদুল আলম বলেন, ‘এখন মানুষ অনেক সচেতন। সমস্যা বুঝে ডাক্তার থেকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে বাসায় চিকিৎসা করে, অনেকে মুমূর্ষ অবস্থা না হলে হাসপাতালমুখী হতে চায় না। আর এতে বোঝা যাচ্ছে নগরীতে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।’
বন্দর-পতেঙ্গা-ইপিজেড হাসপাতালে মাত্র একজন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন। আধুনিক চিকিৎসা উপকরণ সমৃদ্ধ পতেঙ্গায় গড়ে উঠা সিএমপি-বিদ্যানন্দ হাসপাতালে রোগী রয়েছেন ৩২ জন। এবিষয়ে হাসপাতালটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এখন অনেক হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার হওয়ায় মানুষ সেখানে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে এককভাবে কোনো হাসপাতালের উপর চাপ কমছে। একইসাথে আগের চেয়ে আক্রান্তের হার কমে যাওয়ায় কমছে রোগীও।’
তবে হালিশহর আল মানহিল নার্চার হাসপাতালের ৩৮টি বেডের মধ্যে ২৭ জন, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের ৩৪টি বেডের মধ্যে ২৮ জন, করোনা আইসোলেশন সেন্টারে ১০০ বেডের মধ্যে ৩২ জন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৫০ বেডের আইসোলেশন সেন্টারে ২১ জন, বন্দর হাসপাতালে ১৩ জন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৯০ জন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫৯ জন, রেলওয়ে হাসপাতালে ২ জন, হলিক্রিসেন্টে ৮ জন, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে ৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
মুমুর্ষ রোগীও কমে গেছে
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাধারণত চট্টগ্রামের মুমুর্ষ রোগীগুলো ভর্তি হয়ে থাকে। কিন্তু সেই হাসপাতালে ২০০ বেডের মধ্যে ১৫৯ বেডে রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক ডা. এস এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে গত এক মাস আগেও যেমন রোগীর চাপ ছিল এখন তেমন নেই। আমার রেড জোনে (করোনা পজিটিভ) রয়েছে ৬৮ জন ও ইয়েলো জোনে (করোনা উপসর্গ) রয়েছে ৫১ জন রোগী। এতে মনে হচ্ছে চট্টগ্রামের করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।’
একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী। তিনি বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাধারণত মুমুর্ষ রোগীরা ভর্তি হয়ে থাকে। কিন্তু এই দুই হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে রোগীর চাপ কম। একইসাথে অন্যান্য হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে রোগী অনেক কমে গেছে। এতেই বুঝা যাচ্ছে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।’
করোনা পরিস্থিতি উন্নতির কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত করোনা আইসোলেশন সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সুশান্ত বড়–য়া বলেন, ‘এখন মানুষ করোনা পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা বুঝে গেছে। গুরুতর অবস্থা হলেই হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে আসে। তাছাড়া আক্রান্তের হারও কমে গেছে।’
আগামী তিন সপ্তাহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ
করোনা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে, তবে আগামী তিন সপ্তাহ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতিতে আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। কিন্তু আগামী তিন সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়টি সঠিকভাবে পার করতে পারলে ভালো হয়।’
তিনি আরো বলেন, আগামী সপ্তাহে কোরবানির ঈদ। মানুষজন ঈদ করতে বাড়িতে যাবে। পশুর বাজারে গিয়ে গরু কিনবে। অনেক মানুষের সাথে সংমিশ্রণ হবে। তবে যাতে তা ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য আমরা বাজারগুলোতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলছি, মানুষকে সচেতন হতে বলছি। কিন্তু অনেকেই মুখে মাস্ক পরছে না এবং অবাধ চলাচল বেড়ে গেছে। এতে করোনা পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তা নিয়েই শঙ্কা।
এই শঙ্কার কথা চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বীও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদ পরবর্তী দুই সপ্তাহ আমাদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই সময়ে অনেক মানুষের সংমিশ্রণ হবে বলে এতে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৩ এপ্রিল। তারপর থেকে ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও ২৭ মে থেকে তা সবচেয়ে বেশি বাড়তে থাকে। পুরো জুন মাস ছিল বাড়তির দিকে। পরবর্তীতে জুলাই মাস থেকে কমতে থাকে করোনা রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৬৯৯ জন এবং এদের মধ্যে মারা গেছে ২২৮ জন ও সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৮৩২ জন।