কবিতা

মন অসুখের হরিণী

মিজান মনির

খুব টানছে আমাকে—
মধুপুর, ছলইগাছতলা, ধুপুড়নি ও নাইতারঅ ভাঙা
কুহেলিয়া নদী, ছমির মাঝির গান, বিকেলে আড্ডা
হে শৈশব-কৈশোর তোমার প্রেমে বিভোর
খু-উ-ব ভোরে শিশির মাড়িয়ে লাকড়ির সন্ধানে
পান্তাভাতে মরিচভর্তা রসনা জ্বালিয়ে

সাথে ছিল মন অসুখের হরিণী
গোপন স্বরে ডাকে এসো পাশে নেই কেউ!
বন্ধুর পথ সাথে কৈফিয়ত!
কী যে গরম! তবুও নেই শরম
পাহাড়ের আড়ালে আলতো ছোঁয়ায় ভুলে যায় সব পাপ!

অমলিন চুম্বন দেখে প্রজাপতিও হাসে
সারাক্ষণ উড়ে বেড়ায় পাহাড়িফুল-দূর্বাঘাসে।

 

প্রক্রিয়া

সুহিতা সুলতানা

মেয়েটি কৌশলের ওপর দিয়ে যেতে চাইছিল
ভূমিপুত্রের নিকট কিন্তু অধঃপতন তার পিছু
ছাড়ছিল না।অন্যদের অপরাধগুলো মাথায়
নিয়ে সে যখন জঙ্গল অতিক্রম করতে উদ্যত
তখন দ্বন্দ্বের জটিল প্রক্রিয়া তাকে কুহুকিনী
দ্বীপের দিকে ধ্বংস ও মৃত আত্মার কাছে
নিয়ে যায়। তার দ্বিধাবিভক্ত চিন্তাকে ব্যক্ত
করবার যে অভিপ্রায় তার ভেতরে ছিল তা
দাসত্বের অন্ধকারে ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে
যেখানে জীবন ও মহত্বের কোনো মূল্য নেই

 

অস্তিত্ব

ইফতেখার রবিন

কে যেন নামে ধীরে, অনুচ্চারে,
রাত্রির অন্ধ ছাদের ওপারে।
চেনা নয়, তবু চেনা লাগে
যেন নিজেরই ছায়া অন্য কারও দ্বারে।

জানলার কাঁচে কুয়াশা জমে,
আঙুল রাখতেই নিঃশব্দে মুছে যায়;
ধোঁয়ার মতো মুখ ভেসে ওঠে
হয়তো আমি, হয়তো আমার পরিণাম।

অন্ধকার জানে, আমি এখনো বেঁচে আছিত্ম
শুধু আলোয় তা ধরা পড়ে না।
হয়তো আমিই সেই ডাক,
যে নামে বেনামে ডাকে
কখনও নিজেকেই,
কখনও শূন্যতাকে।

 

 

নগরের হাসি

মিসির হাছনাইন

হেমন্তের শীতল ঘুঘুডাকা ভোরে
ঠোঁট বাঁকা নরম নাকডাকা রোদ
জানালার হিম কাঁথায় মুড়িয়ে ঘুম
ঝিলিমিলি স্বপ্নের গালে মিটমিট হাসি
সাদা রঙের সাদাসিধা বাঁকা কোমর
সে রাস্তাটা ঘুরে গেলে পায়ে পায়ে শিমুল
কুড়িয়ে নেয়া ফুলে গাঁথি মালার গান
সে গানটা অন্ধকার চুলের বেণী সাবধান
আলতো করে ধরতে গিয়ে হারিয়েছি হাত
চেনা পাপে নষ্ট হলো আরো একটি রাত
জীবন আমি গুনতে গিয়ে মৃত্যু গুনি সাত

 

 

আমার নীরবতা

সুব্রত আপন

আজ কেন জানি রুঢ় আবেগে জেগেছে জোয়ার
শ্রাবণ মেঘের দিনে সন্ধ্যাতারা মিটিমিটি জ্বলছে
দখিনা বাতাস যেন ছুটে যাচ্ছে ওই পারিজাত বনে
দূর দিগন্তে কে যেন ডাকছে প্রিয় প্রিয় বলে
তবে কি ধরা দিল প্রেম!

যখন মনের বাগানে কৃষ্ণচূড়া ফুটে লাল হলো
বসন্ত ছুয়ে জাগলো কামনার ঘোর
একদিন ঠিকই আসলে আমার দুয়ারে—
আমার নীরবতা ভাঙার উন্মত্ত অপ্সরী হয়ে।

অথচ দ্যাখো আমার মধ্যে বয়ে যাচ্ছে অবিরাম বৃষ্টি
তবুও ভীরু মনে হাত ছুঁয়ে বলা হলো না
বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

বলতে না পারা সেই ব্যর্থতা আমাকে
এখনো ছুঁতে দেয়নি রোমাঞ্চিত রাত্রি—পার্থিব সুখ
এখনো ঘুমের আবাহনে সারথী হারানোর আর্তনাদে
চিৎকার করে বলে ওঠে—ভালোবাসি-ভালোবাসি।

 

যাত্রী

স্বরূপ ভট্টাচার্য

ট্রেন চলে গেলে মনে পড়ে, যাত্রী হয়ে এসেছি এই স্টেশনে।
মেঠো পথ ধরে, রঙিলার দীঘি আর সেবা খোলা পাশে রেখে
একছুটে পেরিয়ে এসেছি অর্ধশত বছরের সমূহ অতীত।
মানিক চৌধুরীর বাড়ি হয়ে গেছে হরি নারায়ণের রাজ প্রাসাদ,
পূর্ণ চৌধুরীর মন্দিরের সেবায়েত সেজে গেছে আশ্রিত সাধুরা,
প্রতিদিন এক পোয়া চালের মজুরি পায় পুরোহিত স্বপন ঠাকুর।
ট্রেন চলে গেছে, পরের ট্রেনের ঘন্টি আর বাজাবে না স্টেশন মাস্টার!

স্টেশন থেকে দেখা যায়, খিল পাড়া আর ইব্রাহিম সওদাগরের বাড়ি।
তারও আগে সওদাগরের ভিটেতে আজ ধানক্ষেত, খিলপাড়া সেজেছে রোহিঙ্গা আবাসে,
এখানে কোথাও নাকি রাজপুত্র শাহ সুজা বিশ্রামে গিয়েছিল পালানোর কালে।
আমি তো ট্রেনের যাত্রী, ধুলোমাখা পায়ে বসে আছি প্লাটফর্মের মেঝেতে,
কখন আসবে ট্রেন! সময় গুনতে গিয়ে চোখ পড়ে হলুদ দুর্বাঘাসে।

ওপাশে নিবারণ সওদাগরের দোকান, আমাদের সকল পকেটে ওরিয়েন্টাল বিস্কুট,
দাম মাত্র পঁচিশ পয়সা। কমলমুন্সির বাজারটা জমে গেছে সারি সারি দখলি দোকানে,
শুধু তার হাতে গড়া মাটির কালি মন্দির থেকে খসে পড়ছে বালির পলেস্তারা।
মা কালির সামনে বসে বদনির মা হাঁকে, মা তোমাকে এখানে এনেছে কারা?
কারো জানা নেই। বদনিকে নিতে এসেছিলো এক হাাঁড়ি মিস্টি নিয়ে,
মিস্টির মতো চুষে খেতে খেতে নিয়ে গেছে অজানা ঠিকানা।
আমিও ট্রেনের যাত্রী , এসবে আমার আজ নাই প্রয়োজন।

ফাস্ট ট্রেন চলে গেছে, এরপরে সেকেন্ড ও থার্ড ট্রেন, আসবে দশটার গাড়ি।
জমে যাচ্ছে যাত্রীদের লাইন, আর কেউ ফিরবে না ফেলে আসা অপেক্ষার বাড়ি।
সাদা বালিগুলো ভিজে আছে কার্তিকের কুয়াশায়, রাস্তাটাও মিশে গেছে বিশ্বাসে আর অবিশ্বাসে।
ওয়াসিম ফকিরের দরগা, দশভূজা বাড়ি দূরে সরে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে কানু শাহ।
ওখানে এখন আর পড়বে না জাগরণ পুঁথি, এখানে এখন শুধু স্মরণের দীর্ঘশ্বাস!
চোখ ফেরালেই চোখে পড়ে শ্রীমাই পাহাড়, পাতা, ঘাস।
ট্রেন এসেছে চলে, আমিতো ট্রেনের যাত্রী, ট্রেনেই ঘুমানোর ছলে খুঁজে নেবো ইতিহাস।