আজির হাসিব :
কবিতা আসলে কী? এ রকম প্রশ্ন এখন চারদিকে শোনা যায়। মনভরে শুনি। উত্তর অনেকে দিয়েও থাকেন। অনেক উত্তরে তুষ্ট হই। কারো-কারো উত্তরে এক রকম অতৃপ্তি থেকে যায়। খুব দাবদাহের কালে কেউ যদি কুসুম গরম পানি পান করে তাহলে তৃষ্ণা নিবারণের বদলে পিপাসাপ্রার্থীর তীব্র বিরক্তির উদ্রেক হয়ে থাকে। কবিতা কীÑ এ বিষয়ে অনেকের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও কারো-কারো উত্তরে ঐ পিপাসার্ত লোকের মতোই অতৃপ্তি থেকেই যায়। আর, তাই তো কবিতা নিয়ে একটু-একটু ভাবতে ই”েছ করে যদি কারো অতৃপ্তি না-লাগে। ক্রৌঞ্চমিথুনের বিরহে শোকার্ত মুনি বাল্মীকি অভিশাপবাক্য উ”চারণ করেছিলেন, শোকার্ত হয়ে উ”চারণ করেছিলেন বলে এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শ্লোক’। আর, এই শ্লোক থেকেই কবিতার উদ্ভব হয়েছিল বলে শাস্ত্রকারেরা মনে করেন। এ রকম ধারণা হতে পারে, শুধুমাত্র শাস্ত্রীয়। আসলে এর কতটুকু উপযোগিতা আছে বাস্তবক্ষেত্রে তা জানা এক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কবিদের কাছে জানতে ই”েছ হয়, তাঁরা কোন্ বাস্তবতায় প্রথম দিন কবিতা লিখতে বসেছিলেন?
অথবা, রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের গাছতলায় পায়চারী করতেন তখন হয়ত সৈয়দ মুজতবা আলী সেটা জিজ্ঞেস করতে পারতেন ‘গুরু, প্রথম তোমার কলমে ‘কীভাবে হিন্দু মেলার উপহার’ কবিতা সৃষ্টি হল? এর আগে কি মুনির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল না-বউদি কাদম্বরীর বিরহে ব্যাকুল হওয়া মন বাল্মীকির মতো শোকাহত শ্লোক উ”চারণ করেছিল! হয়ত গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও রম্যসাহিত্যিক মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে এ রকম ঘটনাবিষয়ক কবিতার তাম্রলিপি উদ্ধার হতে পারত। বিষয়টি নিয়ে তেমন সুরাহা না দেওয়া গেলেও অন্তত এটা বলা যায়, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ভেতরে বিরহ ছিল কম-বেশ। পাওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল, না পাওয়ার বেদনা ছিল বলেই ভালোবাসাকে কবিতায় অনন্য উ”চতায় অঙ্কন করেছেন এভাবে : ‘ভালোবাসো/ প্রেমে হও বলি/ চেয়ো না তাহারে/ আকাক্সক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।’
অথবা, এরপর রবিঠাকুর আর যদি কোনো জবাব দিতে আপাতত অপারগতা জানান, তাহলে আর করার কী-ই বা আছে। কারণ, নিমতলা শ্মশানঘাটে আর অপেক্ষা করার সময় যখন পাঠক-লেখক কারোই নেই তখন যদি কাজীদার জানালায় উঁকি দেয় কেউ তাহলে তো সেখানে দেখা যায় বিরহের মিছিল, শোনা যায় অভিসম্পাত বাণী : ‘বুঝবে সেদিন বুঝবে/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে / বুঝবে সেদিন বুঝবে’। আসলে এখনো অজানা নার্গিস আসার খানম কিংবা ফজিলাতুননেছা কাকে তিনি এই অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন! কেউ কেউ বলে থাকেন, নার্গিসের সন্তানেরা সব নজরুলের মতোই হয়েছে; আর ফজিলাতুননেছা গরিব কবির পাণিগ্রহণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ইউরোপে স্বামীর হাত ধরে কালো গ্লাসের ভেতরে যখন সাঁই সাঁই করে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন তখন সমুদ্রবিলাসে কিংবা বারবিকিউ পার্টিতে আড্ডার অবচেতনে ঐ বাবরিচুলের ছেলেটাকে মনে করেছেন। তখন হয়তো কাজীদা কোনো ফুটপাতে কিংবা বস্তিতে মদপান করে বুঁদ হয়েছিলেন। তাহলে ঘুরে-ফিরে এই অভিশাপ বাণীই কি ধীরে-ধীরে সুন্দরী-শোভনা নারী-পুরুষের অবয়বে কবিতায় রূপ নিল। অভিশাপটি হয়ে গেল বিউগলের করুণ সঙ্গীতের মতো। এজন্য কি প্রাচীন শাস্ত্রবিদ কিংবা আলংকারিকেরা কবির সৃষ্টিকে ব্রহ্মার সৃষ্টি থেকে শ্রেয় বলতে চেয়েছেন। অথবা, চারদিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যব¯’ার মধ্যে যে অসাম্য, শোষণ-নির্যাতন কিংবা সাম্প্রদায়িকতা দেখেছিলেন তা দেখে কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল কঠিন জীবনবোধ; তা-ই তাঁকে ‘বিদ্রোহী’ করে তুলেছিল বলেই কি কবিতায় নিজেকে ‘বিদ্রোহী ভৃগু’বলে আখ্যা দিয়েছিলেন!
এরপর একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক কলকতার ট্রাম দুর্ঘটনার আগের অবিকল অন্তর্মুখী মানুষটির কাছে। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হোক যে, ‘তুমি ‘বনলতা সেন’কে নিয়ে কবিতা লিখেছো, তো এত ভালো কবিতা কীভাবে তুমি লিখতে পারলে?’Ñনিশ্চয়ই এই কবিতা একজন কল্পমানবীকে বনলতা সেনের মতোই প্যারালাল করে তুলেছ, নিশ্চয়ই তুমি বনলতাকে কাছে পাওনি, খুব কাছে, যেখানে দূরত্ব বিলীন হয়ে যায়, দুজনের আত্মার বিলাপানন্দে। অথবা, ক্ষণিকের জন্য পেয়েছিলে বলেই এত কল্পনা করতে পেরেছিলে। যদি তুমি তাকে এ রকম দূরত্বহীন অব¯’ায় পেয়ে যেতে তাহলে এত চিত্রকল্প আর ইতিহাসের পিঠে ঘুরাতে পারতে কি-না। বলতে পারতে কি-না ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’! সত্যিকারের ব্রিটনি কিংবা কারিনা কাপুর কিংবা মেডোনাকে খুব কাছে থেকে পেয়ে গেলে এই লাইনগুলো জীবনানন্দ লিখতে পারতেন কি-না। এদেরকে হয়তো পাননি, অথবা ক্ষণিকের মনোহর অবলোকন ছিল, অথবা, দেখেছেন দূর থেকে, কামনার বহ্নিজ্বালা লুটিয়ে পড়েছে বনলতা সেনের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। তাই তো স্তনকে তুলনা করেছেন ‘করুণ শঙ্খের’ সঙ্গে। অথবা এই অন্তর্মুখী মানুষটি নিরুপায় হয়ে বলেই ফেলেছেন ‘ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে/ অবহেলা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে/ ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে’। তাহলে বাল্মীকি মুনির অভিশাপ শ্লোক আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের এই শ্লোকগুলো তো একই বিরহপারিজাত শোকক্রন্দন-ধ্বনি যা মৃতব্যক্তিকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় বিউগলে যে করুণ সুর বেজে ওঠে তাঁরই নামান্তর কবিতাসঙ্গীত।
এতসব মুক্তকথার পর এবার যাওয়া যাক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে। তাঁর অনুভূতি চমৎকার। তিনি কবিতাবিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গেছেন। তাঁর ভাষায় :
Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings : it takes its origin from emotion recollected in tranquillity; the emotion is contemplated till by a species of reaction the tranquility gradually disappears, and an emotion, similar to that which is before the subject of contemplation, is gradually produced, and does itself actually exist in the mind.
…Poet binds together by passion and knowledge the vast empire of human society, as it is spread over the whole earth, and over all time. The objects of the poet’s thoughts are everywhere; though the eyes and senses of man are, it is true, his favourite guides, yet he will follow wheresever he can find an atmosphere of sensation in which to move his wings. Poetry is the first and last of the all knowledge…
কবিতা সম্পর্কে কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের এই অভিমত খুবই প্রাসঙ্গিক বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি কবিতার প্রকরণের ওপর জোর না দিয়ে কবিতার সংবেদনিক গভীরতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন চিরন্তন সত্য, আনন্দময় রহস্য ও প্রজ্ঞাকে। এবং তিনি কবির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে দৃষ্টি দিয়েছেন ইন্দ্রিয়নির্ভরতার সীমার ঊর্দ্ধে। আসলে ওয়ার্ডওয়ার্থের ভাষায় একজন কবি হবেন উদার উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবহমান দৃষ্টিসম্পন্ন, মানবজীবনের গভীরে, অনুভব ও চিন্তায় যুক্ত করে নেবেন পরমসত্যকে।
একই বিষয়ে আরো একজন বিখ্যাত কবির দরজায় কড়া নাড়লে কবিতা সম্পর্কে তাঁর মুক্তভাবনা জানা যায়। তিনি ইউরোপিয়ান কবিতাবিষয়ে একটি বিখ্যাত বইও লিখেছেন ‘এ ডিফেনস অব পয়েট্রি’ নামে। তিনি নিজেও কবি। শেলিকে চেনেন না-এরকম কবিতার পাঠক খুঁজে পাওয়া হয়ত বেশ কঠিন। শেলি কবিতা সম্পর্কে বলেছেন :
…কবিতা এক আশ্চর্য মুকুর, যা এমনকি কুৎসিতের প্রতি”ছবিকেও সুন্দর করে তোলে।…কবিতা বাহ্য আবরণ সরিয়ে ভেতরের সত্য প্রকাশ করে বলেই সে মুকুরে সবই সুন্দর। তাই আপাতদৃষ্টিতে বিকৃত জিনিসও কবিতায় সুন্দর। সে সৌন্দর্য চিরকালেরও বটে।
শেলি কবিতা সম্পর্কে যে-মতামত ব্যক্ত করেছেন অনেকের কাছেই তা যৌক্তিক। তিনি কবিতার শিল্প আর জীবনের শিল্পকে এক করে দেখেছেন। এজন্য তিনি কবিতার বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, প্রকরণের ওপর নয়। এজন্য বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর কিছু অনুযোগ রয়েছে এরকম ‘কবিতার সৃজনী ছোঁয়া নেই বলেই বিজ্ঞান বাহ্য জগতের ওপর মানুষের অধিকার যত বাড়িয়েছে, মনোজগৎকে সঙ্কুচিত করেছে ততটাই।’ শেলি কবিতাকে দেখেছেন অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার শক্তি হিসেবে। কবিতাই যেন অসুরের বিরুদ্ধে সুরদেবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এরপরও কবিতা বিষয়ে কিছু সংশয় থেকে যায়। থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। কারণ, কবিতা একটি ইন্দ্রজাল, যা ভেদ করে কবিতার আসল সংজ্ঞা হয়ত বের করা যাবে না। তথাপি এ নিয়ে আলোচনা চলছে এবং বিস্তর চলার সুযোগ আছে। এসব আলোচনা-সমালোচনা ও কবিতার পাঠের মাধ্যমেই কবিতার মূল সংজ্ঞা অনুভবযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীর যাবতীয় অশুভশক্তির সামনে কবিতাই হতে পারে শুভশক্তির মূর্তপ্রতীক। তাই কবিতাবিষয়ে আরো ভাবতে আধুনকিতাবাদী কবি টিএস এলিয়টের কাছে যাওয়া যাক। দেখা যাক, তিনি কবিতাবিষয়ে বা কবিতার সংজ্ঞার্থ নিরূপণে কী বলতে চান। তবে তিনি ওয়ার্ডওয়ার্থের চেয়ে কিছুটা ভিন্নরকম মতামত দিতে পারেনÑএটাই স্বাভাবিক। একজন ভিক্টোরীয় যুগের এবং অন্যজন ভিক্টোরীয় যুগোত্তর কবি। এছাড়া, দুজন মানুষ তো কবিতার ভাষানির্মাণে যেমন আলাদা, মননেও তো স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে দীপ্যমান। এলিয়টের ভাষায় :
Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality. But of course, only those who have personality and emotion know what it means to want to escape from these things.
…The business of the poet is not to find new emotions, but to use the ordinary ones and, in working them up to poetry, to express feelings which are not in actual emotions at all. And emotions which he has never experienced will serve his turn as well as those familiar to him. Consequently, we must believe that `emotion recollected in tranquillity’ is an inexact formula. For it is neither emotion, nor recollection, nor without distortion of meaning, tranquillity.
(আগামী সংখ্যায়)