নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
একটানা তিনদিনের ছুটিকে ঘিরে প্রায় দুই লক্ষাধিক পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার সকাল থেকেই সৈকতের বালিয়াড়িতে যতদূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। দীর্ঘ বালিয়াড়ি জুড়ে মানুষের স্রোতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই!
জানা গেছে, সৈকত ছাড়াও জেলার প্রায় সবগুলো পর্যটন স্পটে শত শত পর্যটকের উপস্থিতিতে এখন প্রাণচঞ্চল। সেন্টমার্টিন দ্বীপ, মহেশখালী আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক, দরিয়ানগর, সোনাদিয়া, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকাগুলোতে বিপুল পর্যটকের সমাগম রয়েছে। এ ছাড়াও কক্সবাজার শহরের বার্মিজ মার্কেট, রাখাইন পল্লী, বৌদ্ধ মন্দির ও রামুর বৌদ্ধ মন্দিরেও পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
পর্যটকদের আগমনকে কেন্দ্র প্রায় মাস দেড়েক আগে থেকেই কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনের হোটেলগুলোতে তিনদিন পর্যন্ত বুকিং শেষ হয়ে যায়। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটের পর্যটকবাহী ৮টি জাহাজের টিকেটও শেষ হয়।
রাজধানী ঢাকার উত্তরা থেকে কক্সবাজার ভ্রমণে আসা এমএ কাদের দম্পতি বলেন, টানা তিনদিন ছুটি পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে পৌঁছেছি। ২৫দিন আগে হোটেল-মোটেল জোন কলাতলিতে একটি হোটেলে রুম বুকিং দিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে রওয়ানা দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ করে মাঝপথে এসে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায় তারা রুমটা অন্যদের সেল করে দিয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখি কোনো হোটেল ফাঁকা পাইনি। তবুও বিশাল সমুদ্রের সামনে এলে মনটা জুড়িয়ে যায়। এটাই কক্সবাজার ভ্রমণের আনন্দ।
সেন্টমার্টিন ঘুরে এসে ক্লান্ত হারাধন চক্রবর্তীর বাড়ি ফেরার পালা। বন্ধুসহ তিনি এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। হারাধন চক্রবর্তী জানান, বিজয় দিবসকে ঘিরে কক্সবাজারে পর্যটক বেশি আসছে। এ কারণে হোটেল পাওয়া যাবে না তাই আগেভাগেই সোমবার কক্সবাজারে এসেছিলেন তিনি। মঙ্গলবার সেন্টমার্টিনে গিয়ে দেখেন, সেখানে পা ফেলার জায়গা নেই। হোটেল না পেয়ে তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে বুধবার রাতে মাহাবুব নামে এক স্থানীয় সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় নেন তারা।
ঢাকার বসুন্ধরা থেকে সপরিবারে কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন মো. সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, ইনানী, হিমছড়ি, পাটুয়ারটেক, রামুর বৌদ্ধবিহার দেখেছি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। যে কারণে সৈকত ও আশেপাশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পর্যটকরা।
এদিকে পর্যটকদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউসগুলোতে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে এখানকার হোটেল, মোটেলগুলোতে থাকার জায়গাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ ডিসেম্বর বেশিরভাগ হোটেল ও গেস্টহাউসগুলো বুকিং হয়ে গেছে। ৫ লাখের অধিক পর্যটক উপস্থিতির আশা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এ তিনদিনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে বলেও আশা করছেন তারা।
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান জানান, বিজয় দিবসের টানা সরকারি ছুটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভের হোটেলগুলোতে বুকিং প্রায় শেষ। এছাড়া আগামী ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর এবং ৩০, ৩১ ডিসেম্বর ও পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত দিনগুলোর জন্যও আগাম বুকিং শেষ হয়েছে।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এসএম কিবরিয়া খান জানান, বিজয় দিবসের ছুটি উপলক্ষে সেন্টমার্টিনের জাহাজ ও হোটেলগুলোতেও আগামী চারদিন পর্যন্ত বুকিং শেষ। বর্তমানে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ৭টি এবং কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন ও চট্টগ্রাম-সেন্টমার্টিন রুটে একটি করে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে। তিনি আরো জানান, প্রতিবছর দুই ঈদ, দুর্গাপূজা ও ইংরেজি নববর্ষে কক্সবাজারে সর্বোচ্চ পর্যটকের ঢল নামে। তবে করোনার কারণে গতবছর মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস বন্ধ ছিল কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্র। তবে আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে সীমিত পরিসরে পর্যটন শিল্প খুলে দেয়ার পর গত ইংরেজি নববর্ষে কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
এসময় একদিনেই কক্সবাজারে ৩/৪ লাখ পর্যটক সমাগম ঘটে বলে জানান পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তাদের ধারণা, করোনার টিকা চালু হওয়ায় এ বছর পর্যটকদের ঢল আরো তীব্র হতে পারে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ ১১টি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র। পর্যটকদের করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বদা সচেতনতামূলক মাইকিং ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যটক হয়রানি বন্ধে মাঠে থাকছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। কোথাও পর্যটক হয়রানির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা, তথ্য সেবা, পানীয় জলের ব্যবস্থাসহ নানা সেবামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মো. জিল্লুর রহমান।
তিনি জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্বপালনে রয়েছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। মোতায়েন রাখা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশও। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে পর্যটন স্পটগুলো। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত সাধারণ চিকিৎসা ও খাবার পানির ব্যবস্থাও রয়েছে।
এদিকে সাগর পাড়ে ভাড়া দেওয়া বসানো চেয়ারগুলোতে অসংখ্য পর্যটক হোটেলে রুম ভাড়া না পেয়ে রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। মশার উৎপাতে সারারাত নির্ঘুম থেকে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আবার হোটেলে রুমে উঠতে না পেরে বহু পর্যটক পর্যটন স্পটগুলো না দেখেই রাতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ির টিকেট কেটেছেন।