রাজিব শর্মা »
লাগামহীনভাবে বাড়ছে ওষুধের দাম। নানা দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন জেনেরিকের (একই উপাদানসম্পন্ন বিভিন্ন কোম্পানির) ওষুধ। নগরের হাজারিগলি, জিইসি মোড়সহ বিভিন্নস্থানে সরেজমিনে দেখা যায়, ওষুধের দোকানে বিভিন্ন জেনেরিকের ওষুধ কোম্পানিভেদে বিক্রি হচ্ছে ভিন্ন দামে।
আগে হাড়ক্ষয় রোগী তেমন দেখা যেতো না। বর্তমানে অস্টিওপোরোসিসের রোগের প্রভাব বাড়ছে। এ রোগের আইব্যান্ড্রনিক এসিড বিসপসফোনেট জেনেরিকের ওষুধের বেশ চাহিদা রয়েছে। যা বাজারে ১৬ থেকে ২০টি কোম্পানি বাজারজাত করছে। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানি ছাড়া বাকিগুলো তৈরি করছে ১৫০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট। যা বিক্রি হতো প্রতি ট্যাবলেট ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। বর্তমানে তা বেড়ে তিনগুণের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে লাবাইড ফার্মার বোনাইড প্রতি ট্যাবলেট কিড ১ হাজার ৫০০, ওরিয়ন ফার্মার বনকেয়ার ১ হাজার ২০০, হেলথকেয়ার ফার্মার বন্ড্রাভা চারগুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯৬০ টাকা। আবার রেডিয়েন্ট ফার্মার বনোভা ৫ গুণ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০৭ টাকা।
অ্যান্টিবায়োটিকের দাম চড়া
বাজারে ব্যাকটেরিয়াল ফাংশন-ভাইরাসজনিত নানা রোগের কারণে সেফালোস্পেরিন জাতীয় সেকেন্ড ও থার্ড জেনারেশনের ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। ফলে অন্যান্য ওষুধের মত অ্যান্টিবায়োটিকের দামও চড়া। অ্যান্টিবায়োটিক সেফট্রিয়াক্সন, সেফিক্সিম, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যামিক্সোসিলিন জেনেরিকের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও সিরাপ ফরম্যাটে রয়েছে শতাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের। ট্যাবলেট ও ক্যাপসুলগুলোর কোনোটি ৫০০ মিলিগ্রাম আবার কোনোটি ২০০ বা ২৫০ মিলিগ্রাম। এসব জেনেরিকের ওষুধগুলোর দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কোম্পানিভেদে রয়েছে দামের পার্থক্য।
বাজারে সেফিক্সিম ট্রাইহাইড্রেট জেনেরিকের ২০০ মিলিগ্রামের স্কয়ার ফার্মার সেফ-৩ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা, মেডিমেট ফার্মা থ্রিআরডি সেফ ২৭ টাকা, অ্যারিস্ট্রোফার্মার অ্যাফিক্স ৪৫ টাকা, এসিআই ফার্মার সেফিম-৩ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। যা প্রত্যেকটি আগে বিক্রি হতো ২৮ থেকে ৩০ টাকায়।
আবার জটিল উপসর্গ সারাতে নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে সেফুরক্সিম এক্সিটিলের সঙ্গে ক্লাবুলানিক এসিড মিশ্রিত জেনেরিকের অ্যান্টিবায়োটিকের চাহিদা বাড়ছে। এ ব্র্যান্ডের ৫০০ মিলিগ্রামের অ্যান্টিবায়োটিক ইউনিমেড আ্যান্ড ইউনিহেলথ, অ্যারিস্টোফার্মা, ইনসেফটার মতো কোম্পানির প্রতি ট্যাবলেট ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে বিক্রি হতো ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে বেড়েছে ওষুধের দাম
দেশে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে মেটফরমিন হাইড্রোক্লোরাইড জেনেরিকের ওষুধেরও। তবে বছরের ব্যবধানে এসব ওষুধেরও দাম বেশ বাড়তি। ৮৫০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট বিক্রি হতো প্রতিটি আড়াই টাকা এবং ৫০০ মিলিগ্রামের দেড় টাকা করে, একই ওষুধ বাজারে প্রতি পিস বিক্রি করছে ৫ থেকে ৮ টাকা। তাছাড়া গ্লিক্লিজাইড জেনেরিকের ওষুধ বিক্রি হতো ৪ থেকে ৫ টাকা, একই ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকার উপরে।
হাজারিগলিতে ওষুধ কিনতে আসা ব্যবসায়ী মো. আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘পরিবারে বাবা ও মা দুজনই ডায়াবেটিস ও হৃদরোগী। তাদের জন্য প্রতিমাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয়। দুবছর আগে যে ট্যাবলেট প্রতি পাতা ৩০ টাকায় কিনতাম তা এখন ৭০ টাকা। যে ক্যালসিয়াম ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় পাওয়া যেত তা এখন ১১০ টাকার উপরে। সাধারণ মানুষ আর ওষুধ খেতে পারবে না।’
বাজারভর্তি ভেজাল গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ
অন্যদিকে গ্যাস্টিকের ওষুধের নামে ওমিপ্রাজল, ইসমোপ্রাজল, র্যাবিপ্রাজল জেনেরিকের নানা কোম্পানির ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বাজারে। পরিচিত ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলোকে হুবহু নকল করে, একই নামের আগে বা পরে বর্ণ পরিবর্তন করে একই মোড়ক ও রঙ ঠিক রেখে বাজারজাত করছে নানা কোম্পানি। ওষুধ ক্রেতারা খুচরা ওষুধ কিনতে গিয়ে বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে কোনটি নকল বা প্রকৃত ওষুধ। এসব বিষয়ে কোন ধরনের তদারকি নেই বললেই চলে।
তাছাড়া একই জেনেরিকের গ্যাস্টিকের ওষুধের রয়েছে দামের তারতম্য। রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস যে ওষুধের দাম রাখছে চার টাকা, সেই একই ওষুধ অন্যরা বিক্রি করছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। আবার একই জেনেরিকের ম্যাউক্রো প্যালেট সমন্বয়ে (মাম্পস) গ্যাস্টিকের ওষুধ নানা কোম্পানি ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭ থেকে ১০ টাকা দামে। পাশাপাশি বেশ চড়া দাম রয়েছে র্যাবিপ্রাজল, ইসমোপ্রাজল জেনেরিকের গ্যাস্টিকের ওষুধেরও।
কোতোয়ালি মোড়ে আলমগীর নামে এক ক্রেতা গ্যাস্টিকের ওষুধ কিনতে এসে বলেন, ‘বর্তমানে বোঝা মুশকিল আসল ওষুধ কোনটা। গত পরশু এক দোকানিকে বললাম ‘সেকলো’ দিতে, সে আমাকে কেটে দিয়েছে ‘সেলো’ নামে একটি ওষুধ। দুটার গায়ের মোড়ক একই। এ ধরনের একশ্রেণির অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে।’
ড্রপের দাম বাড়তি
শুধু ট্যাবলেট বা সিরাপের দাম বাড়েনি, বেড়েছে চোখ, নাক, কানের ড্রপের দামও। তাছাড়া কোম্পানিভেদে বেশ দামের তারতম্যও রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক লোমেফ্লক্সাসিলিন ০.৩% জেনেরিকের অপসো স্যালাইনের লোফেক্স ড্রপের দাম ৭০ টাকা, রেম্যান ড্রাগের লোমেসিন ড্রপের দাম ৬০ টাকা, জেসন ফার্মার অপটিপ্লক্স ড্রপের দাম ৫০ টাকা হলেও আবার হেলথ কেয়ার ফার্মার অফটিলোম ড্রপের দাম ৮০ টাকা। আবার হাইপ্রোমেলোলোজ ০.৩% এর জেনেরিকের চোখের ড্রপে অপসো ফার্মার আইফ্রেশ ৭০ টাকা, গণস্বাস্থ্য ফার্মার ৫০ টাকা, বে´িমকো ফার্মার হাইপ্রোসল ৬৫ টাকা। এভাবে ক্লোটিমাজল, বিটামেথাসন, ডেক্সামেথাসন, অক্সিমেথাজোলিন, এজেলাস্টিন, জেন্টামাইসিনসহ নানা জেনেরিকের ড্রপের দাম বেশ চড়া। একই জেনেরিকের একই মানের ওষুধের দামে কেন এত পার্থক্য উত্তর নেই ওষুধ বিক্রেতাদের কাছে।
হাজারিলেনের ব্যবসায়ী মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আসলে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কোম্পানিরা। আমরা অর্ডার দেওয়ার পর বাজারে ওষুধ আসলে তখন জানতে পারি ওষুধের দাম বাড়ছে। ৬০ মিলিগ্রামের ১২ টাকার নাপা সিরাপ এখন ৩৫। ১০০ মিলিগ্রামের ৫০ টাকা। তারা যেভাবে দাম নিচ্ছে আমাদের সেভাবে বিক্রি করতে হচ্ছে। গত দুবছর ধরে ওষুধের দাম বাড়ছে।
একই এলাকার সেফা ড্রাগ হাউসের ম্যানেজার বলেন, ‘নিত্যপণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ছে। পেশাগত কারণে ওষুধ রাখতে হচ্ছে। যে মানের অ্যান্টিবায়োটিক ১৫ থেকে ২৭ টাকা ছিল তা এখন ৫০ টাকার উপরে।’
চড়া দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ বাজারজাতকরণের সাথে জড়িতরা বলেন, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে দেশীয় বাজারে এখনও ওষুধের দাম তেমন বাড়েনি। তবে ওষুধ তৈরিতে যেসব রাসায়নিক পর্দাথ ব্যবহার হয় প্রায় আসে আমদানির মাধ্যমে। গতবছর থেকে দেশে ডলার সংকট, এলসি খরচ বৃদ্ধি, রাসায়নিক দ্রব্যের সংকটের কারণে দাম বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিকারের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা ওষুধের বাজারের প্রতি নজর রেখেছি। ওষুধের বাজারে সরকারের নির্ধারিত দর ও ওষুধ কোম্পানিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে কেউ দাম বেশি রাখছে বা ভেজাল ওষুধের বিষয়ে আমাদের অভিযোগ দিলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
চড়া দাম ও একই জেনেরিকের ওষুধের দামের পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. কাইয়ূম বলেন, ‘ওষুধ কিনতে গিয়ে যে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঢাকা অফিস থেকে। দামের বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় দেখবে।’
ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফার্মেসিগুলোতে ভেজাল ওষুধ বিক্রির বিষয়টি আমরা নজরদারিতে রেখেছি। গত পরশুও একটি আইন পাস হয়েছে। আগে যেসব ব্যবসায়ী নকল ওষুধ বিক্রি করে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে পড়তো, এখন তা আর পারবে না।’