সঞ্জয় দাশ »
অনেক বড় একটা ঘূর্ণিঝড়ে টেক্সাসের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ শহরের হিউস্টোনেও এর ধকল গেছে বেশ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহায়েত কম নয়, তিন থেকে চারদিন বিদ্যুৎ ছিলো না। আর বিশ্বের এমন এক শক্তিশালী দেশে শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড়েই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ভাবতে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলো রোহিত। প্রকৃতির বৈরিতা থেকে কারো নিস্তার নেই, এটা সত্য, তাই বলে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর সেই দেশে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা শেষে দ্রুত রিকভার করতে না পারার বিষয়টি বেশ অবাকই করেছে। তবে ওয়েলসের বক্তব্য হলো ‘উন্নত রাষ্ট্র বলে কি সবই সম্ভব?’
সেদিন ওয়েলস ফোন না করলে এতকিছু যে ঘটে গেছে তার কিছুই জানত না রোহিত। প্রায় ২২ দিন পর তার সাথে যখন রোহিতের কথা হচ্ছিলো তখন বাংলাদেশ সময় রাত আড়াইটা।
তুমি এত রাতে কী করছো?
তোমার ভয়েস শুনব বলে জেগে আছি।
বাংলা সিনেমার ডায়ালগ কপচাও কেন?
সত্যি তোমার ভয়েস শুনব বলে ফোন করেছি।
তারপর তোমার কী অবস্থা?
এইতো চলছে।
ফোনে অনেক ছবি জমে আছে। কিছু ডিলিট করে ফেলবো ভাবছি।
তুমি বরং আমাকে কিছু দাও; পরে তোমাকে আমি ফের পাঠিয়ে দেবো।
অনেকদিন পর গুনগুনিয়ে গান করতে করতে অনেকগুলো ছবি একসাথে ডিলিট করে দিলো সে এক লহমায়। আবার ডিলিটের পর সেটা জানাতে ভুললো না সে। শুধু বড় মেয়ে রাইসার একটা ছবি পাঠিয়ে সে বললো ‘দেখো তো চিনতে পারো কিনা’?
হুম অসাধারণ এক ছবি। এটা ২০২১ সালের।
তোমার মনে আছে?
হুম, থাকবে না।
আসলে ছবি ফেলতে ইচ্ছে করে না। কারণ ওতে যে স্মৃতিময় নির্যাস থাকে তা মানুষকে নষ্টালজিক করে।
তুমি তো খুব ব্রুটাল। সব ছবি ফেলে দিলে।
জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছি।
ওয়েলসের মুখ থেকে এমন কথা কোনোদিন সে শুনেছে বলে মনে হয় না। কেন বললো সে এ কথা। অথচ দিব্যি অবলীলায় কারণটা জেনে নিতে ভুলে গেলো রোহিত। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রায় আড়াই বছর পর গুনগুনিয়ে কয়েকটা গানের কলি আউড়ালো সে। আর সে অপার্থিব সুরের ব্যঞ্জনায় মুহূর্তের মধ্যেই রোহিত খেই হারিয়ে ফেললো মধ্যরাতে।
দেখো আমার ফোনের চার্জ কিন্তু চলে যাবে। এখানে দুই থেকে তিনদিন বিদ্যুৎ ছিলো না।
তুমি কিন্তু এই গানের রেওয়াজটা ছাড়বে না। সে যতই ব্যস্ততার মধ্যে থাকো না কেন।
হুম… চেষ্টা করবো।
আচ্ছা ফোনটা রেখে দাও। তোমার মোবাইলের চার্জ চলে যাবে।
ঠিক আছে, বলেই ফোনটা কেটে দিলো ওয়েলস। সেদিন তারা ৩৩ মিনিট একনাগাড়ে কথা বলেছিলো।
ওয়েলস-রোহিতের কথা বলার এক পর্যায়ে সেদিন নাফিসা জেগে উঠেছিলো। ওর কান্না শুনতেই ধমকের সুরে তাকে কি একটা বলতেই মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো। এ হলো ওয়েলস। সে খুবই কঠোর, কিন্তু মানবিক। আর তার এই মানবিক বিষয়টি খুবই আপ্লুত করে রোহিতকে। এর পর বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু ওয়েলসের সাথে কথা বলার ইচ্ছে করছিলো রোহিতের। মাঝে মধ্যে মনটা উচাটন হতে থাকে। তখন শুধু তার সান্নিধ্য আর অবিরাম কথা বলার ইচ্ছে তৈরি হয়। বলা যায় একধরনের ছেলেমানুুষিপনা। জাগতিক মোহ মানুষকে কেবল লালায়িত করে অহেতুক ছুটতে। অবিরাম এই প্রেষণা থেকে যেন মুক্তি নেই। মানুষের অবচেতনে থাকা নিগূঢ় অনুভূতির ধুম্রজাল তাকে শুধু খুবলে খেতে থাকে। দেশে থাকাবস্থায় তারা কোনদিন ঘুরে বেড়ায়নি। কেউ কারো প্রতি কমিটেড কিংবা এমন কোনো সম্পর্কেও জড়ায়নি পর্যন্ত; অথচ দিব্যি অবলীলায় ২৫ বছর আগের মুগ্ধতার নির্যাস নিয়েই আবর্তিত হতে থাকা রোহিতের মনটা ‘অঝোরে শুধু কেঁদে যায়……… সাথী হয়ে রয়…..ও তারা …..একাকী সময়……একাকী চাঁদের আলো…….ও একাকী পৃথিবী…….এই মনটা আমার…… এই গানটার মতোই যেন। ওয়েলস তো তাকে স্বপ্ন দেখতে বলেনি ; কিংবা স্বপ্নের বীজ বোনার মতোও তো কিছু হয়নি। এরপরেও কেন অহেতুক উদ্ভট সব কল্পনার ছবি নিয়ে মৌতাতি কুহকে মেতে থাকে রোহিত? নিজের কাছেই কেমন আশ্চর্য মনে হয় তার ভেতরকার সত্ত্বাটাকে।
মাঝে মাঝে অনেক কথা জমা থেকে যায়। কোনো সময় ওয়েলস ফোন করলে মনের গহীনে থাকা কথাগুলো আর বলা হয় না। অথচ এসব কথা তার সাথে শেয়ার করা খুব জরুরি। কিন্তু দিব্যি অবলীলায় সে সব কথা বেমালুম গায়েব হয়ে যায় মন থেকে।
অসময়ে যখন সেসব বলতে ইচ্ছে করে তখন ওয়েলসসের ওখানটায় রাত। এমন সীমাবদ্ধতা মনকে উচাটন করে ফেলে।
বিকেল ৫টা। আপন মনে অফিসে বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিল রোহিত। অনলাইনে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজের শব্দ শুনল রোহিত। কৌতুহল নিয়ে দেখতেই চোখে পড়ার মতো একটা খবর দেখল সে। রোহিত খানিকটা অবাক হলো সুদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকে এসব বিষয় মাথায় আসে কি করে ওয়েলসের। মাঝে মধ্যে ঘুমুতে ঘুমুতে রাত দুপুর করে ফেলে সে। বেশিরভাগ মেসেজই সে পাঠায় রাতে। সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে মধ্যরাতে সে অবসর পায়। হয়তো তখনই সে এসব মেসেজ পাঠায়। দীর্ঘদিন পর তার মেসেজ পেয়ে অকারণেই মনটা পুলকিত হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন পর বাসায় আসলেন মোরশেদুল আলম চৌধুরী। এবার তার বেশ কাজের ধকল ছিলো। এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে যেতে যেতে গলদঘর্ম অবস্থা তার। কিন্তু এত ধকলের পরও তা গায়ে মাখেন না ভদ্রলোক। আচমকা গাড়ির হর্নের শব্দে হতচকিত ওয়েলস অনেকটা ধড়মড়িয়ে উঠে সদর দরজা খুলতেই স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিয়েই সোজা ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলায় হনহন করে উঠে সুদৃশ্য বিছনায় অ্যাটাচি রেখেই বললেন তার একধাপ নতুন প্রমোশনের খবর।
চলো আজ রাতে বাইরে ডিনার করবো
সবে তো এলে। ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে রিফ্রেশ করে আসো। তারপর দেখা যাবে।
এ কথা-ও কথার পর কখন যে বেলা পেরিয়ে রাত হয়ে এলো তারা টেরই পেলেন না।
গভীর রাত। বিছানায় আলগোছে শুইয়ে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী উপন্যাস পড়ছিল ওয়েলস। মাঝপথে এসে তার আর বই পড়া হলো না। কান্না জুড়ে দিলো নাফিসা। অকস্মাৎ কী আর করা। তাকে নিয়েই ঘণ্টাদুয়েক সময় কাটাতে হলো।
আমাকে এক কাপ কড়া ব্ল্যাক টি বানিয়ে দাওতো?
একটু পরে দেবো। মেয়েটা জ্বালিয়ে খেলো।
বৌ কী বললো সেটা খেয়াল না করেই আপন মনে ল্যাপটপ নিয়ে নিজের কাজেই ডুুবে থাকলেন মোরশেদ সাহেব।
খুব ভোরে ঘুম থেকে তার সহজে ওঠা হয় না। আজ দিনটা অন্যরকম সুন্দর। সকাল থেকেই বেশ ফুরফুরে আমেজ নিয়ে থাকা ওয়েলসের মাথায় রক্ত চড়ে গেলো রোহিতের পাঠানো একটা ম্যাসেজ দেখে। মাঝে মধ্যে কী হয় তার কে জানে। এ মধ্য বয়সে এসেও কী সব যে লেখে তার কোনো মাথামুণ্ডু সে বুঝতে পারে না।
ওয়েলস এর হোয়াটস অ্যাপে যে ম্যাসেজটা রোহিত তাকে পাঠিয়েছে তার সামারি ‘একরাশ অভিমান’। এসব তাকে বলে কী হবে। যার সমস্যা সেই সমাধান করুক। এসব বিষয়ে অহেতুক নাক গলাতে নেই; এমন একটা ভাব নিয়ে সেদিনকার মতো রোহিত বিষয়ক ভাবনাকে দূরে রেখে নিজের কাজেই মন দিল ওয়েলস।
সন্ধ্যার নির্জন পুকুর ঘাটে বসে আপন মনে মাছের আনাগোনা দেখছিলেন রোহিত। দীর্ঘসময় পর গ্রামে এসেছেন তিনি। অসীম নিস্তব্ধতায় খাবি খাওয়া সন্ধ্যায় তার হঠাৎ সখ চাপলো ওয়েলসকে একটা ফোন করার। এখন তো আমেরিকায় দিন। ফোন তো দেয়াই যায়। আর দেরি না করে মোবাইলের বাটনে চাপ দিলো সে। বেশ কতক্ষণ রিং বাজার পরও ওপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ রোহিত পানিতে অকারণে ঢিল ছুড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর পুকুর ঘাট থেকে উঠে এসে ভাম্রমাণ টং দোকান থেকে এক কাপ আদামিশ্রিত রং চা খাওয়ার পর মেজাজটা একটু শান্ত হলো। এরপরও থেকে থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারছেন না তিনি। তার ফোনটা কেন ধরলো না ওয়েলস। মাঝে মধ্যে এমন সব অদ্ভুদ ছেলেমানুষিপনা তাকে অপরিপক্ক কোনো যুবকের মতোই মনে হতে থাকে। মানুষের মনেরও একটা খোরাক চাই। কিন্তু সে খোরাকই বা মিলবে কোত্থেকে! ওয়েলসের ওপর অকারণে ভরসা করা রোহিত মাঝবয়সে এসে ভীষণ মুষঢ়ে পড়ে কখনো-সখনো। বাস্তবতা বোধের ঘাটতি নিয়ে পথচলা রোহিতের তাইতো বিষাদের যেন শেষ নেই। রাতভর বারান্দায় পায়চারি আর একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই চলছেন রোহিত। হঠাৎ কী মনে হলো তার অকস্মাৎ ফের ফোন দিলেন ওয়েলসকে। এবার ওপার থেকে সেই মোহাবিষ্ট কণ্ঠের অনুরণন পেলেন তিনি।
কেমন আছ?
এইতো ভালো।
তারপর তোমার কী অবস্থা?
এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম। তোমার ফোন ধরতে পারিনি।
একমাসেরও বেশি সময় চলে গেলো; আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট তো একসেপ্ট করলে না?
আমার ফোনটায় কিসের যেন একটা সমস্যা দেখা গেছে। কোনো কিছু একটা টাচ করতে গেলেই সেটা হাওয়া হয়ে যায়।
এটা আবার কী সমস্যা। তুমি আবার নতুনভাবে সফটওয়ার ইনস্টল করো। তাহলে আর সমস্যা থাকবে না।
না রে বাবা। আমার অনেক দরকারি ডকুমেন্ট চলে যাবে।
ও আচ্ছা।
সেদিনের পর থেকেই ওয়েলসের ওপর রাগটা ক্রমে বাড়তে থাকলো। ওয়েলসের সাথে অনলাইনে রোহিতের যোগাযোগ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। এত বছর পর তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর বিষয়টা না ভাবালেও ইদানিং কেন বিষয়টা নিয়ে অমন উঠেপড়ে লাগলো বিষয়টা বোধগম্য নয় ওয়েলসের। (চলবে)