ঐক্যবদ্ধ না হলে জলবায়ু যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত

সাধন সরকার :

জলবায়ু যুদ্ধে ঐক্যের ডাক দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- ঐক্যবদ্ধ না হলে জলবায়ু যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত। বিখ্যাত ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের এপ্রিল সংখ্যায় এক নিবন্ধে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। তবে করোনা-কালের মধ্যে এ বছরের উল্লেখযোগ্য একটি খবর হলো- যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তিতে আবার ফিরে এসেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগেই ঘোষণা করেছিলেন জলবায়ু ইস্যুতে তিনি কাজ করে যাবেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আগামী ২২-২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য এ ভার্চুয়াল বৈঠকে বিশে^র ৪০ রাষ্ট্রনেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেবেন এ সম্মেলনে।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশে^র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা পিছিয়ে গেছে। এ বছরের নভেম্বর মাসে স্টকল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী ও নেতৃত্বস্থানীয় প্রভাবশালী দেশ জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে আসায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা আরও গতি পেয়েছে। দেশি-বিদেশি সব জরিপ ও আলোচনায় ওঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার উপকূলীয় দেশগুলো। আরও নির্দিষ্ট করে বললে এশিয়ার উপকূলীয় গরিব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইতিমধ্যে তিনি দেশে-বিদেশী প্রশংসা কুড়িয়েছেন, পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ৪৮টি উন্নয়নশীল দেশের জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের’ (সিভিএফ) নেতাও। কপ-২৬ সম্মেলনের আগে চলতি মাসের এ সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে এখনো পুরোপুরি একমত হতে পারেনি। যে মাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা তিনগুণ হারে না বাড়ালে সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। কেননা কার্বন নিঃসরণে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কাজ সমন্বিতভাবে ফল বয়ে আনবে না ।

‘জি-২০’ দেশসমূহ বিশে^র মোট ৮০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। বাস্তবতা হলো, স্বল্পোন্নত দেশসমূহ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে খুবই কম। কিন্তু সেই স্বল্পোন্নত দেশসমূহ কার্বন নিঃসরণের কারণে  জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি শিকার। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশে^র উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো হুমকিতে রয়েছে। বিশে^র বৃহত্তম দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাসমূহে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অনেক আগেই পড়তে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের ছোট ছোট দ্বীপসমূহ জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে। উপকূলীয় জেলাসমূহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাতে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে আগের থেকে অনেক বেশি শ্রম ও অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। উপকূলের বহু এলাকায় বারংবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে মানুষ জীবনের তাগিদে বাপ-বেটার ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। অনেকে দীর্ঘদিনের চাষবাসের পেশা ছেড়ে অকৃষি পেশায় চলে যাচ্ছে। উপকূলে খরার কারণে কোনো কোনো এলাকায় জমির পর জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। অভিযোজন করেও উপকূলের মানুষ টিকতে পারছে না। ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে উপকূলের মানুষ গ্রাম ছাড়ছেন।

লোকগণনার হিসাবও বলছে, খুলনা বিভাগের খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরার জনসংখ্যা প্রতিবছরই কমছে। কেননা মানুষ জলবায়ু দুর্যোগের শিকার হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগতে থাকা উপকূলীয় জেলাসমূহের সৌন্দর্য দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণ-প্রকৃতির অনেক আধার নষ্ট হয়ে গেছে। জলাভূমি, খাল-বিল ভরাট করা হয়েছে এবং হচ্ছে। জলবায়ুর শিকার হওয়া উপকূলীয় জেলাসমূহে নজর দেওয়া দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি আর সেই ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলাসমূহ যদি বছরের পর বছর উপর্যুপরি দুর্যোগের কবলে পড়ে তাহলে এ জনপদ টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। উপকূলের প্রাণটা যেন দিনে দিনে মরে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকাও মহাসংকটে পড়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুরা শহরে এসে ভিড় জমাচ্ছে। এভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকলে উপকূল জনশূন্য হয়ে পড়বে এবং অপরিকল্পিতভাবে শহরে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাবে।

অনুষ্ঠেয় এই জলবায়ু সম্মেলনে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ সভ্যতা ও মানবতাকে রক্ষা করার স্বার্থেই জরুরি। টিকা পেতে যেনো বৈষম্যের শিকার না হয় কোনো দেশ তা নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে। সকল মানুষের সুরক্ষা না হলে বিশ্ব নিরাপদ নয়- এই কথা সকলকে উপলব্ধি করতে হবে।

করোনা মহামারি বিশ^কে দেখিয়ে দিয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির ভারসাম্য কতটা জরুরি। জলবায়ু-স্বাস্থ্য-প্রকৃতি এখন সবচেয়ে বেশি সংকটে। আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি কোন পৃথিবীকে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাব? সব দেশই যদি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে তাহলে কেন সব দেশ মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারবে না? সময় এসেছে  ধনী-গরিব সব দেশকে এক কাতারে এসে জলবায়ু যুদ্ধে সামিল হওয়ার। কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত দেশসমূহকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। সব দেশকে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহারে জোর দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার যত বেশি বৃদ্ধি পাবে এ ধরণী তত বেশি টেকসই ও নিরাপদ হবে।

 

লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশকর্মী

ই-মেইল : [email protected]