একুশ, মাথা নত না করার দিন আজ

একুশের চেতনা কী? একুশের চেতনা মূলত ন্যায্যতা। ন্যায় পাওয়ার সংগ্রাম। ন্যায় মানে মতো বা মতন। যেমন, আমরা বলি ‘আপনার ন্যায় আমিও পেতে পারি’। ‘আপনার ন্যায় বাঁচতে চাই’। ১৯৫২ সালে বাঙালি এই কথাটি বলেছিল। আপনার ন্যায়, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের ন্যায় মাতৃভাষায় কথা বলতে চাই।
বুকের রক্ত দিয়ে এই ন্যায়টি প্রতিষ্ঠা করেছে বাঙালি। তারপর থেকে বাঙালির এই ন্যায়ের যুদ্ধ বা সংগ্রাম চলতে থেকেছে। ‘স্বাধীন জাতির ন্যায় বাঁচতে চাই।’ তারপর যুক্ত হয়েছে। আপনার ন্যায় বাঁচতে চাই। স্বাধীন জাতির ন্যায় বাঁচতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করা চাই। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেসব শর্ত একে একে পূরণ করে জাতিকে নিয়ে যান সে তুমুল সময়ে আর সে সঙ্গে একটি মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলেন তিনি।
একুশ যে ন্যায়ের কথা বলেছিল, তা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বলেছিল। ‘আপনার ন্যায় আমিও বাঁচতে চাই’ এই দাবিই ছিল মুখ্যত। রাষ্ট্র ও সমাজের সবটুকু কতিপয় ব্যক্তি ভোগ করবে আর অধিকাংশই তা থেকে বঞ্চিত হবে সেটিও একুশের চেতনা নয়। দুর্নীতি করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে, লোপাট করে, জনগণের ভাগ মেরে দিয়ে, কতিপয় ব্যক্তি বা পরিবার রাজার হালে থাকবে, জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবে তা হবে না। ভেজাল, নকল, মানহীন খাদ্য খাইয়ে, ওষুধ গিলিয়ে যারা সমাজে নির্বিকারভাবে বসবাস করবে তা হওয়ার নয়। দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করে নিজেদের জন্য নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করবে তা হওয়ার নয়। নির্দিষ্ট অংকের বেতনধারী হয়ে অনির্দিষ্ট অংকের সম্পদের মালিক হবে তা হওয়ার নয়। ক্ষুদ্র ঋণধারীদের কোমরে দড়ি হবে আর বৃহৎ ঋণধারীরা রাজার হালে সমাজে গাড়ি চালিয়ে ধুলা উড়িয়ে যাবে তা হওয়ার নয়।
একুশের চেতনা ন্যায্যতার কথা বলেছিল। জাতির জনক মুক্তির কথা বলেছিলেন। ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলে, ন্যায়ভিত্তিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই শুধু একুশের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে। জাতির জনকের সে ‘মুক্তি’ সাধিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে।
শহিদ মিনার। আর তার সূত্র ধরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারা একত্রিত হয় বাঙালি হিসেবে। এই যে ঐক্য ও চেতনা তা কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠা ভ্রাতৃত্ববোধকে কাজে লাগিয়ে অসাম্প্রদায়িক, উদার ও সমতাভিত্তিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সে মুক্তির পথ সুগম করতে হবে। একুশ এসে প্রতিবছর সে কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আমাদের স্মরণশক্তি ফিরিয়ে আনে। বায়ান্ন মানে একুশ আর একুশ মানে মুক্তি- সে অন্ধকার থেকে, কূপমণ্ডূকতা থেকে, প্রহেলিকা থেকে, শোষণ-বঞ্চনা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অমানবিকতা-নিষ্ঠুরতা থেকে। সকল অসুন্দর থেকে।