একটি দেশের একাধিক বন্দর থাকার অনেক সুবিধা। একক বন্দরনির্ভরতা বৈদেশিক বাণিজ্যে সব সময় ঝুঁকি তৈরি করে। বাংলাদেশে এই ঝুঁকি একটু বেশি। কারণ, কর্ণফুলী নদীর সরু চ্যানেল অতিক্রম করে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয়। কোনো কারণে এই নৌপথে বড় দুর্ঘটনা হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের ব্যাঘাত তৈরি করবে। এ জন্য কারখানার কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য বড় বড় শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি বন্দর সুবিধা দরকার। চট্টগ্রামের মতো অন্য জায়গায় বন্দর সুবিধা বাড়লে দেশের শিল্পায়নেও তা সহায়ক হবে।
মোংলা ও পায়রা বন্দরের ব্যবহার বাড়ছে। তাতে একটু স্বস্তি হয়েছে রপ্তানিকারকদের। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ আরও কমে আসবে। কারণ, পায়রা ও মোংলা বন্দর উন্নয়নে কাজ হচ্ছে। অন্যদিকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হয়ে গেলে আরও সুবিধা হবে। পদ্মা সেতু হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ উন্নত হয়েছে। এ কারণে পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে মোংলা বন্দর ব্যবহার বাড়ছে। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও তাদের মনোনীত শিপিং এজেন্ট নিয়োগ শুরু করেছে এই বন্দরে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলায় মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ‘আপগ্রেডেশন মোংলা বন্দর প্রকল্প’ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই।
বন্দরটি বর্তমানে লোকসান কাটিয়ে লাভের ধারায় ফিরে এসেছে। পশুর নদীর আউটারবারে ড্রেজিং করায় হারবাড়িয়া পর্যন্ত সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে। ইনারবারে ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে যেন বন্দর জেটিতে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারে।’
মোংলা বন্দরের আপগ্রেডেশন কাজটি সম্পন্ন হলে এটি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠবে। এর মাধ্যামে শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোও উপকৃত হবে।
আর্থিক দিক থেকে লাভবান না হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচের কারণে গত বছর পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছিল সরকার। তবে আবার পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দরে উন্নীত করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বহির্নোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনা ও লাইটারেজ কার্যক্রমের মাধ্যমে সীমিত আকারে বন্দরটি চালু রয়েছে।
কনটেইনারের প্রায় পুরোটাই চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে। কনটেইনারকেন্দ্রিক পণ্য খালাসের অবকাঠামো সুবিধা চট্টগ্রামেই বেশি। বিশ্বের সব শিপিং কোম্পানির পণ্য পরিবহন সেবা রয়েছে চট্টগ্রামে। বন্দর থেকে শুরু করে কনটেইনার পরিবহনে বেসরকারি ডিপোসহ লজিস্টিকস সুবিধা রয়েছে শুধু চট্টগ্রামে।
২০২৬ সালে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হবে। মাতারবাড়ী টার্মিনালটি চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন, তবে বন্দরের মূল স্থাপনা থেকে দূরে ভিন্ন নৌপথে অবস্থিত। এখানে ১০ মিটারের চেয়েও গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। এই গভীর সমুদ্রবন্দরকে বলা হচ্ছে গেম চেঞ্জার। জেটিতে যত বেশি গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যায়, তত বেশি পণ্য পরিবহন করা যায়। তাতে যেমন পণ্য পরিবহনের খরচ কমে, তেমনি বন্দরের সক্ষমতাও বাড়ে। বন্দর সুবিধার বড় উপাদান এটি।
চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমার শেষ প্রান্তে ইপিজেডের পেছনে সাগরপার থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের অদূরে রাসমনিঘাট পর্যন্ত প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার লম্বা এলাকায় বে টার্মিনাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বন্দরের। অনেক আগে এই টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখনো নির্মাণকাজই শুরু হয়নি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সব সময় এই টার্মিনাল নির্মাণে তাগিদ দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য অর্থাৎ ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে এসব বন্দরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এক চ্যানেলের (কর্ণফুলীর নৌপথ) ওপর সারা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চাপ কমাতে সরকার অনেকগুলো বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব বন্দর এখন দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার নিতে শুরু করেছে। এক বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা দিয়ে দেশের সব অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব নয়। পায়রা, মোংলা, মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়নের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন লজিস্টিকস ব্যয় কমবে, অন্যদিকে পণ্য দ্রুত আনা-নেওয়া করা যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে গতি বাড়াবে।
এ মুহূর্তের সংবাদ